নানা রঙের দিনগুলি - আরতি মিত্র (Arati Mitra), পত্নী (Wife)
একসাথে চলার শুরু সন 1962 থেকে। বিয়ের পরের কয়েক মাস আঁটপুর গ্রামে কাটিয়ে চাকুরী ক্ষেত্রর কাছাকাছি বেলুড়ে এসে পড়া। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাস থেকে বেলুড়ে থাকা, বরাবরের জন্য শুরু হয়। তখন আমার বড় ছেলের বয়স মাত্র তিন মাস। বালিগঞ্জে প্রথম পরিচয়, সেখান থেকে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে আঁটপুর ,আঁটপুর থেকে বেলুড়। তখন রেল কোম্পানির করণিক, সামান্য মাইনে কোন রকমে দিন গুজরান । বাড়ি ভাড়ার যোগান দিয়ে সংসার প্রতিপালন করাই দুঃসহ বিষয় ছিল । কিন্তু ভাগ্যচক্রে আমি যার হাত ধরে ছিলাম তিনি একেবারেই শ্রমবিমুখ ছিলেন না। শ্রমের কথা জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন, যার ফলশ্রুতি হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি তার মননে স্থান পায়। ভোর সকাল থেকেই উদয়াস্ত পরিশ্রম, এমনকি বালিগঞ্জে যেতে হত বেলুড় থেকে টিউশনি করতে, তারপর ফিরে এসে কোনরকমে গোগ্রাসে গিলে নিয়ে অফিস যাওয়া। অফিসে উনি ছিলেন একাগ্র, সৎ কর্মী। অফিস থেকে ফিরে এসে সাড়ে ছটা সাতটা থেকে টিউশনি। ছোট্ট বাপি মানে বড় ছেলে তখন কোলে। আমার পক্ষে সব কিছু সামলানো সম্ভব হতো না যদি সেই সময় শিবচন্দ্র চ্যাটাজ্জী স্ট্রিটের ভট্টাচাজী পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতা না পেতাম। তিন ভাই ,বোন, মা নিয়ে ভটচাজ পরিবার যারা আমার ছোট্ট বাপিকে নিজেদের সন্তান হিসেবেই দেখভাল করত। তারপর ওদের বাড়িতে প্রথম দুই বউ এসে গেল যারা পিঠাপিঠি বোন। আমার ছোট্ট বাপির কোন আদরের অভাব হয়নি সেখানে। আর আমিও খুব সহজেই সংসার পালন করতে পেরেছিলাম ।
তারপর উত্তাল সেই সময় ১৯৬৭ এসে দুয়ারে হাজির, বেলুড়ে যার প্রভাব পড়েছিল ভীষণভাবে। বলা যায় এই উত্তাল সময় বেলুড়ে মানুষের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটায়।সময় এগিয়ে চলে তরঙ্গের মতো মিলিয়ে যায়। ততদিনে আমার বড় ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়ে কাটিয়ে ফেলেছে দু -এক বছর। বদমাইশ বিচ্ছুটা বেড়ে চলেছে নিজের মত সমাজে সবার সঙ্গে মিশে সবার মতো হয়ে। খুব ছোটবেলা থেকেই ও ওর বাবাকে হিরো মনে করত। আর আমি ওর মা হাজার চুরাশির না হলেও গোটা কতক পোলাপানকে মা এর স্নেহ দিয়ে বড় করেছিলাম। কখনো বাড়ি থেকে ওর ওপর ঠিক করে দেওয়া হয়নি সমাজে ওর মেলামেশার গন্ডি। ছেলেকে নিয়ে মাসে একবার করে উনি যেতেন আঁটপুর নিজের দেশ গ্রামে। বাড়িওয়ালার অসন্তোষ থেকে বাঁচতে হঠাৎ করে রেলওয়ে কোয়াটার নিয়ে চলে যাওয়া লিলুয়া। কিছুতেই ছেলে যাবেনা তার ছোটবেলার সঙ্গ ছেড়ে। ওর প্রানের বন্ধু টুলটুল ও হাজির হয় ছেলের সাথে নতুন আস্তানায় । ততদিনে 70 দশকের আন্দোলন থেমে যাবার মুখে। সত্তর দশকের উচ্ছিষ্ট কিছু লুম্পেন সমাজে ছড়ি ঘোরানোয় ব্যাস্ত। যেন তারাই সমাজের মাথা। নতুন জায়গা সেই অঞ্চলের এই সমস্ত মানুষজন কে.বি. মিত্র কে চেনে না। তাই শুরু হয় তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দ্বন্দ্ব। ভীষণ এই একরোখা মানুষটাকে সামলানো দায়। জীবনে কারো সামনে অন্যায় মাথানত করতে দেখে নি ওকে। মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন, এটা তার সত্তর দশকের শিক্ষা। এই সমস্ত লুম্পেনদের ওনার কাছে শেষমেষ মাথানত করতে হয়েছিল। এই আবহে বেড়ে উঠেছিল বড় ছেলে তার শৈশব নিয়ে।
আমার কোলে দ্বিতীয় সন্তান আসে বাহাত্তরের এপ্রিল মাসে। পঁচাত্তরে এসে যায় রেল আন্দোলন ধর্মঘট। রেল কোয়ার্টারে থাকার দরুন সামনে থেকে দেখতে পাওয়া গেছিল রেল আন্দোলন, যেখানে একটিভ পার্টিসিপেশন ছিল ওনার। উনি প্রথম জীবনে দানাপুর এ পোস্টিং ছিলেন। সেখানকার বন্ধু কেষ্ট বাবু ছিল ওনার খুব ঘনিষ্ঠ। মানসিকতায় উনি এতই যৌথ ছিলেন কেষ্ট বাবুর ছেলেকে এখানে বাড়িতে রেখে উনি পড়ানোর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। আমার সন্তানদের যৌথতা সম্ভবত এই জীবনচর্চার ফলশ্রুতি। আমাদের দুজনের জীবন কি রকম ছিল সেটা বলা হয়নি। স্বামী হিসেবে ওনাকে পাওয়া একজন স্ত্রীর ভাগ্য কারণ উনি যে শ্রম চর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তা গৃহকর্মে ও একই রকম ছিল। তাই ঘরের খুঁটিনাটি সবকিছু নখদর্পণে থাকতো এবং ঘরটাকে মন্দিরের মতো পালন করেছিলেন। কোন কাজ ওনার চোখে ছোট ছিল না। সব সময় সমস্ত কাজ একাউন্টেন্টের নজরে দেখতেন। উনি বলতেন যে আমি রেল কোম্পানির একাউণ্টেট আমার চোখে কিছুই ফাঁকি পড়ে না।
এবার ঘর ছেড়ে বাইরের পথে হাঁটাদিই একটু, আসলে ওনার জীবনটা বাইরেও একই রকম ছিল । ইস্টার্ন রেলওয়ে একাউন্ট রিক্রিয়েসান ক্লাবের দীর্ঘদিনের সম্পাদক ছিলেন। ভীষণভাবে নাট্যচর্চা করতে ভালোবাসতেন। বিখ্যাত নট জহর রায়, মহেন্দ্র গুপ্ত, ঠাকুরদাস মিত্রর সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ এসেছিল ওনার। স্ত্রী হিসেবে সেখানে আমার দায়িত্ব বেড়ে যেত । রিহার্সাল, গেট টুগেদার সবই আমাদের বাড়িতে হত। এই ভাবেই যৌথতার বন্ধনে সমাজের সঙ্গে আবদ্ধ ছিলাম আমরা। উনি শিক্ষক হিসেবে বেলুড়ে প্রসিদ্ধ ছিলেন। সারা পৃথিবী যখন সেরা ছাত্রদের বাছাই করে লেখাপড়া শেখাতে ব্যস্ত। উনি তখন পিছিয়ে পড়া মানুষজনের সন্তানদের শিক্ষক। ওনার ছাত্ররা সব সময় ওনাকে ঈশ্বরতুল্য মনে করতেন। এমনকি প্রতিষ্টিত স্কুল শিক্ষকরা ওনার কাছে আবদার নিয়ে আসতেন তার মেয়েকে ইংরেজি অংক করার জন্য। নাটক করবার কারনে ওনার আবৃত্তির করার অভ্যাস ছিল। উনি নৈবেদ্য কবিতার একটা লাইন মাঝে মাঝে বলে যেতেন ‘সকল গর্ব দূর করি দিব তোমার গর্ব ছাড়িব না।’ এ যেন ওনার উদ্দেশ্যে আমার না বলা কথা।
আমার মা শ্রীমতি ইন্দুমতী রায়চৌধুরী ছিলেন এক অনন্য মহিলা, যিনি কম বয়সে আমার বাবা মারা যাওয়ার দুঃখ কে দূরে ঠেলে দিয়ে পাঁচ ছেলে, মেয়েকে বড় করেছেন তুলেছিলেন পরিশ্রম এবং মেধার সাহায্যে। তার জীবনের পরিশ্রম এবং লড়াই দিয়ে তিনি পছন্দ করে নিয়েছিলেন তার বড় জামাইকে। যিনি মায়ের শেষ জীবন পর্যন্ত মায়ের সকল লড়াইয়ের সাথী কমরেড ছিল।এরপর ধীরে সংসারে স্বাচ্ছন্দ বাড়তে থাকে। দুজনের মিলিত সিদ্ধান্তে উনি বেলুড়ে জমি কিনে বাড়ি করে বরাবরের জন্য বসবাসের নিমিত্ত। বড় ছেলে সরকারি সংস্থায় চাকরি পেয়ে যায়। এতে ওনার নির্ভরতা বাড়ে হাত দিয়ে ফেলেন বাড়ি তৈরীর কাজে। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে সেই বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। এই বাড়ি ঘিরে ওনার যে কত স্বপ্ন ছিল, প্রত্যেক টা ইট যেন ওর বুকের পাঁজর ছিল। বাড়ি তৈরীর সময় উনি ভিত পূজা করেননি। একজন জানতে চেয়েছিলাম যে আপনি কেন ভিত পুজো করেননি । তার উত্তরে উনি বলেন যে আমি চুরিও করিনা পুজোও করি না। এমনই স্পষ্টবক্তা ছিলেন উনি ওনার এই উত্তরে এলাকার ত্রাস সেই ব্যক্তি আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন ।
জীবনের নিশ্চয়তা কে নির্দিষ্ট করতে গিয়ে নিজের ছেলেদের ওপর উনি খুব নজর দিতে পারেননি। নিজের ছেলেরা নিজের মতোই বেড়ে উঠছিল ।শুধু ওনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর ছাপ পড়েছিল ছেলেদের মধ্যে। তারপর একে একে ঘরে বড় বউ আসে, জন্মগ্রহণ করে বড় নাতি। যাকে আদর করে ডাকতেন বন্নু দাদা বলে। বন্নু মানে বদমাইশ দাদা। এই প্রথম এই বাড়ির কোন সন্তান সম্পূর্ণ ওনার মানসিক শারীরিক সাহচর্যে বেড়ে ওঠে। উনি নিজের জীবনের সমস্ত কিছু ঢেলে দিয়েছিলেন নাতিকে বড় করতে। এমন কি দাদার সঙ্গে সিগারেট খেতে হবে নাতিকে । সেই সময় আমাদের পারিবারিক বন্ধু শৈল সাধন সরকার নিয়মিত আসতেন আমাদের বাড়িতে চলত তিনজনে মিলে সিগারেট খাওয়ার পালা। দুজন প্রকৃত সিগারেট খেতেন আরেকজন কে পাকিয়ে নকল সিগারেট দেওয়া হত না হলেই গোঁসা । আমাদের পারিবারিক বেড়াতে যাবার ট্যুরে শৈল বাবু ছাড়াও ছেলেদের বন্ধুবান্ধব বহু মানুষ যুক্ত ছিল। সে এক রঙের বর্ণালী যেন। এরপর ছোট ছেলের চাকরি তার ত্রিপুরা চলে যাওয়া । তারপর বিয়ে, দুই সন্তানের জন্ম নেওয়া । এই ভাবে এগোচ্ছিল দিনগুলো । ত্রিপুরায় গিয়ে আমরা দুজনে ওদের সংসারকে গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিভাবে যে কেটে গেল এত বড় জীবন মুহূর্তে বুঝতেই পারলাম না ।
কেউ কথা রাখেনি !! উনি কথা দিয়েছিলেন আমায়, আমায় মেরে উনি মরবেন। বলেছিলেন তুমি আমার পেনশন ভোগ করবে এমনটা হতে দেবো না। ওনার বেঁচে থাকার বড় সাধ ছিল। আপন ঘরের কোণে ভীষণভাবে আত্মস্থ হয়ে উনি বেঁচে থাকতে ভালোবাসতেন । জীবনের শেষ সীমায় এসে নিজের প্রতিটি কাজ নিজে করতে চেষ্টা করতেন। নিজের জীবন পরিবার এই বাড়িটা কে আঁকড়ে ধরে উনি বেঁচে ছিলেন। যেদিন উনি প্রথম চেক আপ এ গেলেন সেদিন নিজের রক্তাত্ত প্যান্ট কে জলে ডুবিয়ে রেখে গিয়েছিলেন এই আশায় যে উনি ফিরে এসে কেচে পরিষ্কার করে দেবেন। ওর এই শেষ আশা টি পূরণ হয়নি।অপারেশন করার পর ওনার শরীর খারাপ হয়ে যেতে থাকে আমি বাইরে থেকে বুঝতে পারতাম না কারণ ছেলেরা ভরসা যোগাতে সব সময় ঠিক রিপোর্ট জানতে দিতনা ।আমি মনে মনে কামনা করতাম যেন পড়ো হয়ে উনি বেঁচে না থাকেন । ওর মতো ঋজু চরিত্রের মানুষকে আমি পড়ে থাকতে দেখতে পারবো না। ফিরে আসার পর আমার মনে আবার নতুন করে ওঁর বেঁচে ওঠার আশা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে উনি আর হয়তো বাঁচবেন না। তাই প্রাণভরে দেখতে চাইছিলেন সকলকে, আমাদের বলতে চাইছিলেন যে কিভাবে ভবিষ্যৎ সময়টা তোমরা কাটাবে। কেমন ভাবে উনি সব গুছিয়ে দিয়ে গেছেন। নিজের অটুট বিশ্বাস কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গেছিলো। উনি উঠতে চেস্টা করছিলেন বারবার, অপারগ হয়ে শেষমেশ শুয়ে পড়লেন ,আর উঠলেন না । আমার পাশে শুয়ে শুয়ে আমার হাতে জল খেতে খেতে উনি হঠাৎই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অশেষ দুঃখের মধ্যে আমাকে শান্তি দিয়ে গেলেন কারও ভরসায় ওঁকে বেঁচে থাকতে হল না। আমার কাছে এই যাওয়া মহাপ্রস্থানের অন্য নাম।
আমার বাবু দা - শুভ্রেন্দু শেখর রায় চৌধুরী (Subhrendu Sekhar Roy Chowdhury),শ্যালক্ (Borther-in-law)
আমার বড়দার বন্ধু ছিলেন বাবুদা, একই স্কুলে পড়াশোনা করতেন এবং প্রায় একই পাড়ায় অর্থাৎ জামির লেন যেখানে আমাদের বাড়ি সেখানে আসতেন । বাবুদার বাড়ি ছিল কর্ণফিল্ড রোডে। পায়ে হাঁটা দূরত্ব 7 থেকে 8 মিনিটের সেই সুবাদেই দাদা ওনাদের বাড়ি যেতেন এবং বাবু দাও মাঝেমধ্যে আমাদের পাড়ায় আসতেন। একদিনের ঘটনা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল এবং ওনার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছিলাম- একদিন স্কুলের গরমের ছুটি পড়ার দিন আমি এবং আমার স্কুলের বন্ধু দের সাথে ফুল সংগ্রহ করতে গিয়েছি সেই সময় আমাকে কুকুরে কামড়ায়। স্কুলের ছাত্ররা আমাকে বাড়িতে দিয়ে যায়, ওই অবস্থায় বাবুদা আমাকে কাঁধে চাপিয়ে প্রায় দৌড়ে বালিগঞ্জ প্লেসের চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বাবুদাদের আদি বাড়ি হুগলি জেলার আঁটপুরে।বাবুদাদের বালিগঞ্জের বাড়ি এখনো মিত্রঘাঁটি নামে সর্বজনবিদিত। ওনাদের যৌথ পরিবার, জেড়তুতো ভাইরাও এখানেই একসঙ্গে থাকতেন । এরপর কোন এক সময় কর্ণফিল্ড সাহেবের মৃত্যুর পর বাগানের বাড়ির ওপর বিপর্যয় নেমে আসে,বাবুদারা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। এ বহু পূর্বের প্রায় 70 বছর আগেকার ঘটনা। এতদসত্ত্বেও অঞ্চলে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে মিত্রবাগান টা কোথায় লোকেরা ওনাদের বাসস্থানের দিকটাই দেখিয়ে দেবে। যদিও ওখানে এখন বিরাট বিরাট বাড়ি হয়ে গেছে। তবুও 7 নম্বর কর্ণফিল্ড রোড বলতে এখনো মিত্রবাগান বোঝায়। ওই বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আমার দাদা ওনাদের যাবতীয় আসবাবপত্র এবং যাবতীয় সামগ্রী আমাদের বাড়িতে স্থানান্তরিত করে এবং কিছুদিনের জন্য কয়েকজনকে আমাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন। এরমধ্যেই বাবুদা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তখন থেকেই দেখেছি বাবুদার টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। এরপর তখনকার দিনে আইএ পাস করেন পরবর্তী সময়ে গ্রাজুয়েশন করেন। আইয়ে পরীক্ষার ফল বেরোনোর সময় বাবুদা কে বলতে শুনেছি ‘যদি বাংলায় 30 নম্বর পেয়ে যাই আমার ফার্স্ট ডিভিশন কেউ আটকাতে পারবেনা।’ ফল বেরোনোর পর যা বলেছেন তাই হল মেট্রিক পাশ করার পর থেকেই টিউশনি এবং দোকানে দোকানে প্যাকেট করে চা ডেলিভারি দেওয়া দুই হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে চায়ের দোকানে দোকানে ডেলিভারি দেওয়া এই পরিশ্রম বিফলে যায়নি। পরবর্তী সময়ে রেলওয়ে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন চাকরি পাওয়া সত্বেও টিউশনি বন্ধ হয়নি অনেকদিন পর্যন্ত। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে চেতলায় চলে যান। জ্যাঠাইমাদের সাথে চেতলায় উনি থাকতেন। দাদার বন্ধু হিসেবে এবং আমাদের বাড়িতে যাতায়াত সুবাদে আমার মা বাবুদার পিসিমা এবং জ্যাঠাইমার কাছে প্রস্তাব পাঠান আমার বড়দির সাথে বিবাহের প্রস্তাব। পরবর্তী সময়ে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয় । বিবাহের পর বাড়ি ভাড়া করে বেলুড়ে যাওয়া, যেহেতু লিলুয়া কর্মস্থল ছিল তাই সব টিউশনিও সমানতালে চালিয়ে গেছিলেন বালিগঞ্জ এবং বেলুড়ে । পরবর্তীকালে বেলুড়ে জায়গা কিনে নিজের বাসস্থান তৈরি করে পাকাপাকি বেলুড়ের বাসিন্দা হন দিদি জামাইবাবু।
আমার জামাইবাবু - নন্দা রায় চৌধুরী (Nanda Roy Chowdhury), শালাজ সালটা ছিলো ১৯৮০র সেপ্টেম্বর, একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক আমাদের বাড়ির সামনে বাবার নাম ধরে ডাক ছিলেন। আমার ছোট বোন কবি ভদ্রলোককে উপরে নিয়ে এসে বসালো এবং বাবা কে ডেকে আনল। আমি চণ্ডীগড়ের দিদির বাড়িতে চলে গেলাম পরের দিন । চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম চণ্ডীগড় থেকে, লক্ষ্মী পুজোর দিন বাবা এবং মা ছেলেদের বাড়ি বালিগঞ্জে এ যাবেন আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে। বিয়ে হল আমাদের,বউ নিয়ে ঘরে ফিরলেন শুভেন্দু শেখর। বালিগঞ্জে এসে নানান নিয়ম-কানুন হল। জামাইবাবু মাকে ‘বললেন আপনার বৌমাকে এনে দিলাম। এখন আমার দায়িত্ব শেষ।’ ১৯৮১ সালে আমার ছেলে হয়। আমার ছেলে বাবুকে জামাইবাবু একদিন নিয়ে পাড়ার একটা নার্সারী স্কুলে গিয়ে ভর্তি করে দেন। আমি বুঝতে পারি ওঁর প্রয়োজন আমাদের এ জীবনে ফুরবার নয় । আমার স্বামী বলতেন অতীতে বাবুদা আমার মায়ের প্রান ছিলেন।
আমি কিন্তু জামাইবাবুকে ভীষণ ভয় পেতাম যে ঘরে জামাইবাবু থাকতেন সেখান থেকে আমি অন্য ঘরে পালাতাম। দিদিকে ফোন করলে যদি জামাইবাবু হ্যালো বলতেন আমি ফোন ছেড়ে পালিয়ে আসতাম। আমার ভয় ভেঙ্গেছিল সেদিন যেদিন উনি আমায় সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
শেষ না দেখার আফসোস নিয়ে আপনার নন্দা
পরবর্তী প্রজন্ম
নাম ছিল তাঁর জন হেনরি - কৃশানু মিত্র (Krishanu Mitra), জ্যেষ্ঠ পুত্র (Eldest Son) বয়সের হিসাবে মায়ের পরে যে সবচেয়ে বেশি বাবার সাহচর্য পেয়েছে, সে আমি, বাবার বড় ছেলে কৃশানু মিত্র। জীবনের প্রতিটি সফলতা, বিফলতায় বাবা ছিল আমার সঙ্গে। তার সাহচর্য ,তার সাহস, সততা এবং ভুলগুলো নিয়ে আমার জীবনের বিন্যাস। যার ঠিক, বেঠিক মাপবে সময়,পরের প্রজন্ম। ঘোষাল বাবুর বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, জানলা খুললেই মুখাজ্জী পুকুর । আমার পাঁচ বয়স বছর বয়সে বাবা আমাকে নিয়ে সাঁতার শেখাতে নামিয়েছিল সেখানে। সেই প্রথম জলে নামা , আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। বারবার ডাঙ্গার দিকে উঠে পালাবার চেষ্টা করছিলাম। বাবা বকাঝকা করলেও আমি তা মানতে চাইছিলাম না। বাবা রাগ দেখিয়ে আমাকে গভীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কোনরকমে হাত পা ছুঁড়ে আমি বাঁচার চেষ্টা করে ডাঙ্গার দিকে আসতে থাকি,অদ্ভুত ভাবে আমার ভয়টা ভেঙে যায়। জীবনে এই প্রথম মানুষটার কাছ থেকে সাহসী হওয়ার ব্যাকারন রপ্ত করি আমি। যা অনেক পথ পাড়িয়ে আমি বুঝেছিলাম। তারপর থেকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে ওর সাহসে আমি বলিয়ান হতাম। ওঁর ভয় না মানা উচ্চশির আমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করেছিল। এরপরে সত্তর দশকের আগুনের দিন এসে গেল সমাজের বুকে, যার পক্ষে বিপক্ষে হাজারো মানুষ জড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট ডাকু সেই সময় বাবার আচরণে আবিষ্ট হয়ে এই সময়টাকে ভীষণভাবে মহাভারতের যুদ্ধে বিদুরের মতো দেখতে শুরু করেছিল যদিও তার কোনো দায় ছিলনা কাউকে শোনাবার। সেই সময়ে বহু সাধারণ মানুষ, সহযোদ্ধা, এবং বাবা মিলেমিশে অংশগ্রহণ করেছিল রাজনীতিতে। অর্থনৈতিক কারণে আমাকে মায়ের সাহচর্যেই ছোট থেকে বড় হতে হয়েছিল। আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটি সন্তান যেমন এখন বাবার দেওয়া বিশেষ নাম বহন করে, আমারও সেইরকম একটি বিশেষ নাম ছিল ডাকু। লেখাপড়ায় আমি কখনোই ভালো ছিলাম না তার কারণ আমার ওপর নজর করার কেউ ছিলনা। আমরা বেলুড়ের বাড়ি ছেড়ে লিলুয়া রেল কোয়ার্টারে যাই ১৯৭২ সালে। তিনতলায় আমাদের থাকার জায়গা । পাশের মাঠে আমি সারাটা দিন কাটাতাম গুলি ,ক্রিকেট-ফুটবল,লাল লাঠি ,কবাডি, পিট্টু আরো কত কিছু খেলে। কোন বাধা পায়নি বাবার থেকে কখনো। মাঝে মাঝে যখন সন্ধ্যা নেমে যেত সাতটা, সাড়ে সাতটা আমি ঘরে ঢুকছি না অন্ধকারেই আমাদের খেলা চলছে স্ট্রিটলাইটে। দূর থেকে ভেসে আসত বাবার চিৎকার ডাকু.... ডাকু। যেন প্রভুভক্ত কোন কুকুর ডাক পেয়েছে তার প্রভুর।ভয়ের চেয়ে বেশি টানতো সেই ডাক, নিতান্ত অনিচ্ছায় দিতাম এক ছুট। সেই দিন গুলো মণিমুক্তা খচিত আমার জীবনপাত্রে ।
বাবাকে ভীষণ কাছে পেতাম যখন আমি অসুস্থ হতাম। একবার আমার পক্স হয়েছে, চিকেন পক্স, ভীষণ কষ্ট সারা শরীরজুড়ে গুটি গুটি বসন্তের দাগ। টস টস করছে শরীর, যন্ত্রনায় কাতর আমি অন্ধকার ঘরে একা গান গাইছি। ‘যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি।’ বুঝতে পারিনি রাত দুটো আড়াইটার সময় কেউ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমার গান শুনছে। কোথাও গানের মাঝখানে কোনো ব্যাঘাত হতে দেননি তিনি। গান শেষ হলে উনি বলছেন ‘এইতো আমি, এই লড়াইয়ে তোর পাশে আছিতো।’ রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার তার কাছ থেকেই পাওয়া। যদিও তিনি গান গাইতে পারতেন না, কিন্তু শ্রোতা হিসেবে তিনি অনন্য ছিলেন। আমি যখন ভীষণভাবে বিহারী, উত্তরপ্রদেশের বন্ধুদের সঙ্গে বড় হচ্ছি আমার হিন্দি কালচার জীবনের অঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় তিনি একটি টেপ রেকর্ডার কিনে এনেছিলেন। সেন পন্ডিত কোম্পানির একটি ছোট্ট টেপ রেকর্ডার সঙ্গে এগারোটি দেবব্রত বিশ্বাসের ক্যাসেট। আমার সংস্কৃতি হাঁটল এক্কেবারে উলটো পথ, উল্টো মুখে। এইভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি না পেয়েও তিনি ছিলেন আমার কাছে।
পরীক্ষায় খারাপ ফল করতে করতে আমার লেখাপড়ার ওপরই বিরক্তি ধরে গেছিল। ছোটবেলা থেকে ভাবতাম আমি খেলোয়াড় হব। যদিও দূরে দূরে থেকেও আমি বাবার কাছ থেকে অংকের বেসিকস শিখে ফেলেছিলাম। এ নিয়ে সুপ্ত গর্বও ছিল আমার তাই লেখাপড়া আমি পারব না এই বোধ আমাকে কখনো গ্রাস করেনি। শুধু রেজাল্ট কখনোই ভালো করতে পারিনি। বাবা আমার ভেঙে পড়া বুঝতেন ,আমি এই ভাঙাচোরা দিনগুলোতে চাইতাম ওর অদ্ভুত স্নেহের স্পর্শ। যা ঠিক কিরকম বলে বোঝানো যাবে না। ওনার কারণেই আমি ছোটবেলা থেকে প্রশ্ন করতে শিখেছিলাম । যা ভবিষ্যত জীবনে আর এক গুরুর কাছে ফিলসফি বলে জেনেছিলাম। তাই আমার আর লেখাপড়া হলো না । আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কাউকে পেতাম না।মনে আছে আমি যখন এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং শিখছি, আর্টসের ছাত্র বাবা আমায় সাহায্য করছে, প্রথম যখন ক্যালকুলাস শিখছি তখনও। এই বয়স থেকে আমি বাবার সাহচর্য পেতে থাকি। আমার জ্ঞান ভান্ডারের বিস্তার লাভ করল এই প্রশ্নের কারণেই। আমি ভগবানের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম যা ছিল আমার ভবিষ্যতের নাস্তিক্যবাদের মূলভিত্তি।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই যুক্তিপথ হাঁটা বাপিকে, বাবা পৃথিবীর সবার থেকে আলাদা, অন্য চোখে দেখতো। আমার চোখে বাবার অবস্থান ছিল নায়ক বা হিরোর মত। সেই চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে বাবা একই ভাবে একই সম্মান আমাকে দিতেন। কখনো কোনো কারণেই মনোমালিন্য হলে উনি ভীষণ কষ্ট পেতেন, জীবনের শেষ ভাগে এসে সেরকম ঘটনা একবার ঘটেছিল।খুব অভিমানে ভেঙে পড়েছিলেন বাপির উপরে- বাপি আমায় ভুল বুঝল ! সেদিন আমি দেখেছিলাম বাবার চোখে জল। একমাত্র প্রাণের আবেগে আবৃত্তি করার সময় যা স্পষ্ট বোঝা যেত। রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা আমার ওর কাছে পাওয়া। ‘তোমারে যা দিয়েছিনু তা তোমারি দান’, আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল এর উল্টো। আমাকে যা উনি দেননি আমি তাও ওনার কাছ থেকেই পেয়েছি জীবনে। জমিদার সন্তান মিত্রদের আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে,আগের প্রজন্মের প্রতিটি মানুষের মধ্যেই উন্নাসিকতার অবশেষ রয়ে গেছিল,যা হৃত সামন্ততন্ত্রের ছায়া বলে আমার মনে হয়। সুনীল গাঙ্গুলী বলেছিলেন ‘অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কনপরা ফরসা রমণীরা/তারা আমায় দেখে আমোদে হেসেছে।’ এই আক্ষেপের ঠিক উল্টো ভাবনা সঙ্গী করে আমি হেঁটেছি জীবনপথ, সচেতন ভাবে। সামন্ততন্ত্রের কোনও অবশেষ নেই আমার মধ্যে। এ শিক্ষা হয়ত বাবার কাছ থেকেই অবচেতনে পাওয়া। হয়তো তাই বাবা আমাকে খুব র্যাশনাল ভাবতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক চলত আমাদের। বাবা আধুনিকতার সবকিছু মেনে নিতে পারত না, আধুনিকতা মানেই পুঁজিবাদ, এ বিপর্যয় ডেকে আনবেই এই সত্যই তিনি লালন করে এসেছিলেন গভীর বিশ্বাসের সাথে। প্রথমে আমিও এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলাম কিন্তু আস্তে আস্তে নিজের ভুলগুলোকে সংশোধন করতে পেরেছিলাম পরিবেশেগত কারণে। যে গান কে হৃদয়ে নিয়ে আমার এই বিশ্বাস, সেই গান অশ্রুত ছিল বাবার কাছে। আমার স্থির বিশ্বাস – ‘I wish to change again’ শুনলে উনিও বদলে নিতে পারতেন নিজেকে। আমার এই একমাত্র বাসনা অধরা রয়ে গেল জীবনে ।
শ্রমজীবী বাবাকে আমি আবিষ্কার করতাম জীবনের পরতে পরতে। যদিও আমার জীবনে দক্ষ শ্রমিক আমির জন্ম ঘটেনি কখনো । আমি ছিলাম অদক্ষ লেবার। আমায় কেউ জল তুলতে বললে জল তুলে দেবো মাথায় মোট বইতে বললে বয়ে দেবো। কিন্তু একজন দক্ষ, স্কিল্ড শ্রমিক হিসেবে আমি চিরকালই বেমানান। আমার জীবনে আমি একেবারেই পারফেক্সানিস্ট ছিলাম না। বাবার জীবনের দুটি ভাগ ছিল: একটা শিল্প, কৃষ্টি; অপরটি শ্রম ও সৃষ্টি। বাবা সরাসরি দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নির্মাণ করেছেন জীবনে বহু কিছু। আমি সেই অর্থে সৃষ্টি করতে পারিনি কিছুটি। এই হতাশা আমার সারাজীবনের। আমার ভাই যা সহজাত ভাবেই উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছিল। কিন্তু শ্রম আমার জীবনের অঙ্গ হিসেবে আমি মানি , আমার বাবার থেকে শেখা এই অমূল্য নীতিজ্ঞান আমার পাথেও।
বাবার আবৃত্তি করা পছন্দের কবিতার দুটি লাইন লিখে শেষ করি। ‘কেন রে তোর দুয়ার খানি পার হতে সংশয় জয় অজানার জয়।’ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সব বন্ধন নিজের কথা রেখে চলে গেলেন –আমি পড়ব আর মরব। তোমার বাপি/ডাকু
Lockdown-এর এই বিভীষিকা নিয়ে লেখা আমার ছোটগল্প :
আমার বাবা - ববিতা মিত্র (Babita Mitra), জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ (Eldest Daughter-in-law)
বছরটা ১৯৯০, বিয়ের প্রস্তাব আসে বেলুড়ের মিত্র বাড়ি থেকে আমাদের শিবপুরের সিনহা বাড়িতে। কর্মসূত্রে কে.বি. মিত্র এবং অনিল কৃষ্ণ সিনহা এক ই অফিসের কর্মী। প্রস্তাবের সাথে সাথেই আমার গুরুজনেরা বুঝতে পারে বিয়ে ধর্মীয় মতে হবে না, আইনি পথে হবে। বাড়ির সবাই অনিচ্ছুক ছিল বিয়েতে ।কিন্তু আমার মা জেদ ধরে, অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এই পথ মেনে নেয়, হয়ে যায় বিয়ে।
নতুন জায়গা, নতুন আবহ, নতুন মানুষ যাদের সঙ্গে আমায় থাকতে হবে, সেখানে সম্পূর্ণ দুটি আলাদা কালচারের হঠাৎ সংগম । স্বাভাবিক কারণেই অল্প সময়ে মিশেল হয় না। ভিন্ন কৃষ্টির নতুন চলা নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে ঘটতে থাকে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই সন্তান নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। ছেলের হাঁপানি থাকায় আমি ভয়ে জড়োসড়ো থাকতাম। আমার শ্বশুর মশায় অসমসাহসী মানুষ তিনি অনায়াসে আমাকে লুকিয়ে আইসক্রিম খাওয়াতো। দেখতে দেখতে শ্বশুরমশাইয়ের ভাবনাচিন্তার নির্যাস নিয়ে ছেলে বড় হয়ে গেল। আমি সারা জীবন ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ তৈরি করার কারনে। নিরন্তর দ্বন্দ্বের পথ হাঁটতে হাঁটতে গৃহস্থালির যে গান বেজে চলেছিল তার রেশ ধরে কখন নিজের অজান্তেই উনি আমার বাবা হয়ে গেলেন। আর আমি পেলাম মেয়ের সম্মান। রক্তের সম্পর্ক না থেকেও পরমাত্মীয় হওয়া যায় এ তারই এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
মনে আছে শেষের দিনটার কথা যখন উনি ঘরে এলেন,সন্ধ্যা বেলায় প্রানখুলে সবার সঙ্গে অনেক গল্প করলেন,তারপর হঠাত ই চলে গেলেন। ডাক্তার মৃত শনাক্তকরণের পরেও আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না যে বাবা মারা গেছে। আমি বারবার বলতে থাকি আরেকটু পরে নিয়ে যাও এত তাড়াতাড়ি বাবাকে নিয়ে যেও না। মনের কোণে কোথাও লুকিয়ে ছিল অলিক প্রত্যাশা - বাবা মারা যায়নি। একদিন ভোর সকালে আমার স্বামী, কৃশানু, স্বপ্ন ভেঙে ঘুম থেকে জেগে উঠে আমায় বলে, ‘এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, বাবা শব আসন থেকে উঠে বলছেন - বুবাই যখন বারণ করছে তাহলে আমাকে একটু পরেই নিয়ে যাস।’ এখনো প্রতিক্ষণে তুমি আমাদের সঙ্গে আছো তোমার কর্ম নিয়ে, তোমার ভালোবাসা নিয়ে। এই বাড়ি ,বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ ,ইট কাঠ পাথর আসবাবপত্র সবই তোমার ।তুমি চলে যেতে পারো না। তোমার বুবাই
জীবন বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায় -কৌস্তুভ মিত্র (Kaustuv Mitra), কনিষ্ঠ পুত্র (Youngest Son) সংসারমাঝে কয়েকটি সুর রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর দু একটা কাঁটা করি দিব দূর তারপরে ছুটি নিব। সুখ হাসি আরো হবে উজ্জল সুন্দর হবে নয়নের জল স্নেহ সুধামাখা বাস গৃহতল আরো আপনার হবে।
বাবার মুখে মাঝে মাঝেই শোনা যেত উপরের পঙক্তিটি। আসলে বাবা যে এত তাড়াতাড়ি ছুটি নেবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। In fact, আমার মনে হত বাবা যেন সারাজীবন ই আমাদের সাথে থাকবেন। যদিও কবির ভাষায় আর বাবার গলায় অনেকবারই শুনেছি জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে। আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীর মানুষটি ছিলেন ছেলে, ভাইপো-ভাইজি ও নাতি-নাতনিদের কাছে বন্ধুর মত। আজও মনে পড়ে ছোটবেলায় আমার Aquarium এর শখ পূরণ করতে গিয়ে বাবার হাতে গরম পিচ পরে হাতটা কি বীভৎসভাবে পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জন্য আমাকে তখন একবারও বকা খেতে হয় নি। অথচ নিজে এখন সন্তানদের জন্য কিছু করে দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে রেগে গিয়ে বকে উঠি। বাবা জীবনে কোন কাজে কোনদিন বাধা দেন নি আমাদের। খালি কোনো ডিসিশন যদি পছন্দ না হতো বা মতবিরোধ থাকতো তখন বলতেন বুঝলি পাপা এইরকম করলে মনে হয় ভালো হয়। তখন আমি বুঝতে পারতাম হয়তো এটা করা ঠিক হবে না বা আমার চিন্তা ধারায় কোন ভুল আছে।
শৈশব আমার কেটেছিল লিলুয়া রেল কোয়াটারে।যখন কোয়াটারের আশেপাশে বাবার কলিগের সন্তানরা সমমানের সন্তানদের সাথে খেলাধুলায় অভ্যস্ত তখন আমি আর দাদা তথাকথিত নিম্নমানের অবাঙালি ছেলেদের সাথে যারা কেউ কেউ রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো তাদের সাথে খেলায় মত্ত। অনেকে বারণ করতেন বাবা-মাকে ওদের সাথে না মিশতে। মিশলে নাকি স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে। বাবার প্রশ্রয় এতটাই ছিল যে কোনদিন বাড়ন তো করেননি উল্টে সাধ্যমত ফুটবল ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন যাতে আমরা সবাই খেলতে পারি। হয়তো সেই সময় থেকেই ভালো-মন্দের জ্ঞান টা তৈরি হতে শুর করেছিল। সব সময় ভালো রা যে ভালো না বা তথাকথিত মন্দরা অনেকেই ভালো এই বোঝাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
শৈশব লিলুয়া কাটানোর পর 1988 এর 24 ডিসেম্বর বেলুড়ে নিজেদের বাড়ি আমরা চলে আসি। জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয় বিদ্যামন্দিরে পঠনরত শচী দা,সুব্রতদা, অনিন্দ্য দা এবং বেলুড় বয়েজ ও গার্লস এর কিছু সঙ্গী সাথীদের নিয়ে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিজ্ঞান ক্লাবের কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান ও দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরনো পড়ার বই সংগ্রহ করে একটি লাইব্রেরী গঠন করতে ব্যস্ত আমরা মানে আমি, তমাল, অনল, বেজ ,দেবাশীষ , মৌ ,মহুয়া আরো সবাই। তার জন্য দফায় দফায় 14-15 জন এর মিটিং। কিন্তু মিটিং এর জায়গায় কোথায় এত লোকের। সেটাও কিন্তু বাবার প্রশ্রয় আমাদের নতুন বাড়িতেই হতো। যদিও বাবা কিছুটা সময় নিজের মত থাকতে ভালবাসতেন, আমৃত্যু পর্যন্ত তবুও এত বন্ধুর আনাগোনা কোনদিনই বিরোধিতা করেননি। শুধু মিটিং এই শেষ ছিলনা। সারাদিনব্যাপী চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা দেখা একসাথে 30-35 জনের অথবা প্রতিবছর সপ্তমীর দিন যে যেখানেই থাকুক না কেন আমাদের বাড়ি চলে আসা এইসব ও চলত বাবা-মায়ের প্রশ্রয়।
বাবা চারিত্রিকভাবে অসম্ভব দৃঢ় ও সাহসী ছিলেন। মুখের উপর সত্য কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করতেন না, সে ছেলেরাই হোক আর অন্য কেউ হোক। সালটি ঠিক মনে নেই। তবে 1989-90 মধ্যে হবে। সেদিন বেলুড়ের বাড়িতে বাবা, আমার বরদা হীরক মিত্র, দাদা কৃশানু মিত্র ও আমি। মা মামার বাড়ি বালিগঞ্জ গিয়েছিলেন। রাতের খাওয়ার পর আমরা শুতে যাব। সেই সময় পাড়ায় খুব গন্ডগোল। চোর সন্দেহে একজন ধরা পড়েছে আর তার উপর চলছে পাবলিকের গণপ্রহার। আর স্থানটি ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে। কিছু পাবলিক ব্যাপারটা না জেনেই চোর সন্দেহে ধরা পড়া ব্যক্তিটিকে 2-4 ঘা দিয়ে হাতের সুখ করে নিচ্ছিল। ব্যক্তিটির তখন প্রায় অর্ধমৃত অবস্থা। আমরাও পরিস্থিতি সহ্য না করতে পেরে তখন গৃহবন্দী। হঠাৎই বাবা বারান্দায় বেরিয়ে প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন। বললেন আপনারা কি মেরে ফেলতে চান লোকটিকে। আগুনে ঘি পড়ার মতন সবাই হৈ হৈ করে তেরে এল। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ সঙ্গে গেট ধরে ঝাঁকানি কিছুই বাদ রইল না। আমরা তস্ত্র হয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। কিন্তু কাজ হল । সন্দেহভাজন চোর টি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। আমরা সারারাত তিন ভাই চোখের পাতা এক করতে পারিনি সেদিন। পরের দিন অবশ্য জানতে পেরেছিলাম ব্যক্তিটিকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে প্রহার করা হয়েছিল।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইটা যখন লড়ছি তখন বাবার ভরসা ছিল আমার প্রতি অপরিসীম। পরপর কয়েকটি অসাফল্য যখন আমার মনোবল ভেঙে দিয়েছিল বাবা তখনও নিশ্চল ভাবে পাশে থেকে বলে যেতেন “আমি জানতাম তুই এটায় পাবিনা, পরেরবার তুই ঠিক পেয়ে যাবি পাপা”। এই কথাগুলোই হয়তো পরবর্তী সময়ে সাফল্য এনে দিয়েছিল আমাকে। সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তার সূচনা হয় বাবার হাত ধরেই। ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষায় একাউন্টান্সি একটি বিষয় ছিল। আর আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। হিসাব শাস্ত্র কিছুই বুঝিনা। আমি জানতাম বাবা ইন্টারমিডিয়েটে হিসাব শাস্ত্রে 88 % শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য বাবা বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ফি জমা দিতে না পারায় বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা বাবার করা হয়নি তখন। যদিও বাবা হিসাব শাস্ত্রে 88 % শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলা ক্লাস ভালোলাগায় বাবা বি.এ. পাস করেন বাংলা নিয়ে। তাই চাকরি জীবনে উত্তরনের ক্ষেত্রেও সেই বাবার হাত ধরেই হিসাব শাস্ত্রের প্রথম পাঠ।
অফিসে আমার ভাতৃসম সহকর্মীরা অনেক সময় বলে থাকে আমার নাকি কাজ খুঁজে নিয়ে করার অভ্যেস। কিছু ক্ষেত্রে আমি নিজেও ভাবতে শুরু করেছিলাম হয়তো তাই। কিন্তু এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার কোন অবকাশ আমার হয়নি। বাবার মৃত্যুর পর আর লকডাউন এ বাড়িতে অখণ্ড অবকাশে মনে পড়ে গেল আমার স্নাতক হওয়ার পর বাবার কিছু কথা। বাবা আমাকে বলেছিলেন “পাপা, গ্রাজুয়েট তো হয়ে গেলি, এরপর যদি হাওড়া স্টেশনে মুটে গিরিও করিস তাহলে বোঝাটা তুলে পয়সা নিস”। এটাই হয়তো আজও আমার রক্তে মিশে গেছে। আসলে life is nothing when we get everything, but life is everything when we miss something, value of people is realised in their absence only.
Tomorrow, and tomorrow, and tomorrow, Creeps in this petty pace from day to day, To the last syllable of recorded time; And all our yesterdays have lighted fools The way to dusty death. Out, out, brief candle! Life's but a walking shadow, a poor player, That struts and frets his hour upon the stage, And then is heard no more. It is a tale Told by an idiot, full of sound and fury, Signifying nothing. ….দাদার মুখে বহুবার শোনা ম্যাকবেথের পংক্তি
জীবনে কিছু মানুষ যেন মহীরুহ হয়ে থেকে যান, মাটি আঁকড়ে, যারা ঠিক করে দেন জীবন নদী কোন খাতে প্রবাহিত হবে | আমার জীবনে প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এমন মানুষটি ছিলেন আমার ঠাকুরদা যাকে আমি K.B. দাদা বলে ডাকতাম | ছবিতে, আমার অন্নপ্রাশনে দাদাকে আমায় ধরে থাকতে দেখলেও, স্মৃতিতে, দাদার আমার হাত ধরার শুরু তখন আমার বয়স তিনেক | পড়াতে বসে দুষ্টু আমিকে শাসন করতে গিয়েছিল মা | সাথে সাথে ঘটলো দাদার প্রবেশ | বললেন ‘আজ থেকে আমি ওকে পড়ানোর দায়িত্ব নিলাম’| বাচ্চাদের কঠোর শাসন কোনদিনই সহ্য করতে পারেননি দাদা | বাড়ির বাইরেও বাচ্চাদের গায়ে হাত উঠলে চিরকাল উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেছেন, একথা অনেকেরই জানা | এমন করেই আমার দাদার সাকরেদ হয়ে ওঠা |
মনে পড়ে আমার কাকার ত্রিপুরায় যাবার সময়ের কথা (সেটাও আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা), বয়স তখন বছর পাঁচেক | কাকা বলেছিল ‘কাকে নিয়ে যাব রে আমার সঙ্গে’ | আমি প্রথমেই বলেছিলাম ‘মাকে আর দাদাকে যেন নিয়ে যেও না’ | ছোটবেলাটায় এমনই ঘনিষ্ঠতা ছিল দাদার সঙ্গে আমার |
কত কিছুই হতো না হয়তো দাদার আনুকূল্য ছাড়া | ছোট বয়সে পাড়ায় সমবয়সীদের অভাবে খেলতে যেতে পারতাম না আমি | দাদা বললেন ‘ছোট ছেলে, ঘরে বসে কেন?’ | ক্রিকেট ব্যাট-উইকেট কিনে আমায় নিয়ে গেলেন মাঠে যাতে অন্য ছেলেরা আমায় খেলতে দেয় | Umpire হয়ে দেখতেন যাতে আমি খেলতে পারি | তেমনি আমার ক্লাস ফাইভ হওয়ার পর বললেন ‘সাইকেল কিনে আনি, চলো’ | বাড়ির লোকের অমত | আমায় রেললাইন পেরিয়ে নিয়ে গেলেন সাইকেল কিনতে চুপিচুপি | রোজ আমায় সাইকেল শেখাতে হাটা লাগাতেন | দাদা পদব্রজে চলতেন, আমি সাইকেলে ঘুরপাক খেতাম, চাঁদ যেমন পৃথিবীর যাত্রায় ঘুরপাক খেয়ে চলে তেমনি | আর ঘরে যা ছুতোর, কামার, ইলেকট্রিশিয়ান, রাজমিস্ত্রির কাজের ফরমান থাকতো তাতে প্রস্তুত থাকত কর্নেল কেবি মিত্র আর তার সার্জেন্ট আমি | এটাই বোধহয় আমার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা | দাদা চেয়েছিলেন আমি সাঁতারটাও শিখি, সেই ইচ্ছে অবশ্য আমায় অনেক বড় বয়সে পূরণ করতে হয়েছে |
কিন্তু দাদার আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অবদান হয়তো শিক্ষক হিসেবে | দর্শনের ছাত্র দাদার শিক্ষার দার্শনিকতা কিন্তু Cultivate করার মত | কাকার অবর্তমানে তিনতলার ঘরটা ছিল আমার আর দাদার অন্দরমহল, তাতে অন্য কারুর অনুপ্রবেশ নিষেধ | কেউ যদি ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকেও পড়ে তবে দেখতো আমি কখনো মাটিতে শুয়ে, কখনো খাটের তলায়, কখনো বা টেবিলের ওপরে বসে পড়ছি | নির্ভেজাল স্বাধীনতা ও আনন্দ ছিল পড়ার মধ্যে | আমি প্রথমে কিছু পড়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম, না বুঝলে তবে দাদার কাছে নিয়ে যেতাম | আর Jack of all Trades দাদা তখন আমায় বুঝিয়ে দিতেন | কি কঠোর পরিশ্রম করে ইংরাজি শিখিয়েছিলেন আমায় | এক একটি ইংরেজি বই পড়ে অনুবাদ লিখে রাখতেন যাতে আমি নিজে থেকে পড়তে পারি | এমন করেই ইংরেজিতে শেক্সপিয়ার থেকে বাংলায় শরৎ-বঙ্কিম, রবি-নজরুলের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠা আমার | মাধ্যমিক পর্যন্ত দাদাই ছিল আমার একমাত্র Tutor | দাদার শেখানো ইংরেজি-অংকর পসার বহন করে আজও দিন গুজরান করি আমি| দাদা শুধু আর রইল না |
আমার কলেজে যাবার সময় দাদা বলেছিলেন ‘আমার নাতিকে যদি কোন institute না নেয়, তবে ক্ষতি সেই ইনস্টিটিউটের’ | অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা ছিল দাদার ছেলেপুলে ও নাতি-নাতনিদের প্রতি | আশা করি তোমার আস্থা আমি রাখতে পেরেছি | আজ পড়ে আছি বিদেশ-বিভুঁইয়ে | এক মরণব্যাধিতে পৃথিবী আজ থরথরিকম্প, আমি আসতেও পারিনি একবার তোমায় দেখতে | তুমি চেয়েছিলে বোধহয় আমি ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ ফিরে আসি | তোমার চলে যাওয়ার আগে সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি আমি, শেষ দিনগুলোতে পাশে থাকতেও পারিনি | তবু একটাই শান্তি পাই | তুমি চেয়েছিলে আমি গবেষক (বিজ্ঞানী) হই | আমার গবেষণার প্রমাণপত্র ও পান্ডুলিপি তোমার হাতে তুলে দিয়ে যেতে পেরেছি শেষবারে, আশা করি খুশি হয়েছিল |
আমি পরলোকে বিশ্বাস করিনা, দাদাও করতেন না | তবু এই সময়গুলোতে যেন ইচ্ছে হয় বিশ্বাস করতে | মনে হয় ‘বন্নু-দাদা’ ডাকটা যদি আর একবার শুনতে পেতাম | তোমার শেখানো ‘Elegy’ কবিতাটি quote করে বলতে ইচ্ছে হয় Large was his bounty, and his soul sincere, Heaven did a recompense as largely send: He gave to Misery all he had, a tear, He gained from Heaven ('twas all he wished) a friend. Pensioner’s Association এর President হিসেবে যে চলে যেতে হয় সে আগাম বাণী আগেই শুনিয়ে গিয়েছিলে তুমি | ভালো থেকো তো আর বলা হলো না, আমরা ভালো থাকব এই প্রতিজ্ঞা করলাম | তোমার মতই বলিষ্ঠতার প্রতীক ‘বলদেব’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করব, এবং তুমি আমাদের জীবনকে যেমন সমৃদ্ধ করেছিলে তেমনি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে যাবো অন্যদের জীবনকে, এটাই রইল আমার অঙ্গীকার |
ঋজু ,দাদার বিচ্ছু - ক্ষৌণীশ মিত্র (Khaunish Mitra), নাতি (Grand-son) শেষ বিচ্ছু দাদা ডাকটা শুনেছিলাম 1/4/2020 সন্ধ্যেবেলা, দাদাকে চা খাওয়াবার সময়। সেইদিনই দাদা বিকেল বেলা চারটার সময় শ্রমজীবী হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল। দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল এক্কেবারে আলাদা। দাদার এই বাড়িতে সবথেকে প্রিয় জায়গা ছিল ছাদ ও ছাদের ঘরটা। আমার ও বাড়ির সব থেকে প্রিয় জায়গা ওটাই। ওখানে আমরা দুজনে দিনের প্রায় পুরোটা সময় থাকতাম। চারতলায় দাদার যাবতীয় সব রকমের জরুরী জিনিস থাকত।একবার আমি, দাদার চারতলায় থাকা তুলোর বাক্স থেকে তুলো নিয়ে সান্তাক্লজ বানিয়েছিলাম। দাদা জানতো না আমি তার বাক্স থেকে তুলো নিয়েছি। প্রথমে যখন জানতে পেরেছিল তখন একটু রাগ করেছিল কিন্তু পরে বলেছিল বিচ্ছু দাদা সান্তাক্লজ টা ভালো বানিয়েছো। দাদার কাছে হয়তো কোনদিন কেউ মার খায়নি বা মার খেলেও আমি জানিনা। কিন্তু আমি দাদার কাছে অনেকবার মার খেয়েছি। সেই মারে অবশ্য আমার লাগতো না কারণ দাদা আমায় জেনে বুঝে আসতেই মারতো। দাদার সঙ্গে থেকে আমি অনেক কিছু কাজ শিখেছি, ইলেক্ট্রিকের কাজ ,কাঠের কাজ ইত্যাদি। দাদা 80-81 বছর বয়সেও টুলের উপরে উঠে কাজ করতো। টুলটা অবশ্য আমিই ধরে থাকতাম। কিন্তু যখন দাদার বয়স একটু বাড়লো তখন ব্যাপারটা উল্টে গেল,মানে তখন আমি টুলে উঠে কাজ করতাম আর দাদা টুলটা ধরে থাকতো। আরেকটা কথা যেটা আমার এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেটা হলো আমি যখন পরীক্ষায় কম নম্বর পেতাম তখন বাড়ির সবাই প্রায় আমাকে বকা দিত। কিন্তু দাদা আমাকে কোন বকাবকি করত না। দাদা বলত বিচ্ছু দাদা এবার ভালো হয়নি পরের বার হবে, আমি জানি তুমি পারবে। দাদার খুব কবিতা পড়ার শখ ছিল। সারাক্ষণই দেখতাম কবিতা মুখস্থ বলছে। একটা ঘটনা দাদা আমায় অনেকবার বলেছে। এই ঘটনাটা দাদার বাল্য জীবনের ঘটনা। তখন দাদার স্কুলে পরীক্ষা চলছিল। দাদা কোনদিনই কোন পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে যেত না। দাদা যে কোন বিষয়েরই বইটা ভালো করে পড়ে পরীক্ষা দিতে যেত। দাদা বাংলা পরীক্ষাতে একটা প্রশ্নের উত্তর নিজে বানিয়ে লিখে এসেছিল। আর দাদার বন্ধু ছিল বলরাম যে ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। সেই বলরাম ওই প্রশ্নের উত্তরটা পুরো মুখস্থ লিখেছিল তার পরীক্ষার খাতায়।খাতা বেরোনোর দিন দাদা পেয়েছিল বলরাম এর থেকে বেশি নম্বর। বলরাম তখন দাদার খাতাটাতে দেখে ওই প্রশ্নটার উত্তর লাল কালিতে ভর্তি ছিল কিন্তু তার একটাও লাল কালি ছিল না উত্তরে। তবু দাদা কে কেন শিক্ষক বেশি নম্বর দিয়েছিল বলরাম দাদুর তা মাথায় ঢোকেনি। পরে যখন বলরাম তাদের শিক্ষককে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল তখন তিনি বলেছিলেন ও তুই বুঝবি না কেন আমি বলদেব কে বেশি নম্বর দিয়েছি। দাদা এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আমি যখন এখনো চারতলায় উঠি তখন মনে হয় দাদা ওখানেই আছে। আমি আমার এই প্রিয় দাদা যাঁকে আমি কেবি দাদা বলতাম, তাঁর কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। বিচ্চুর প্রণাম।
দাদা ডাকটা বোধহয় আর কোনদিনও ডাকতে পারবো না। দাদা আর আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। দাদা আমায় শাকচুন্নি বা দিদিমণি বলে ডাকত। দাদা আমায় ইংরেজি পড়াতো আবার মাঝে মাঝে অংক ও করা তো। কিন্তু বেশি পড়াতে ইংরেজি। স্কুলের ইংরেজি ম্যাম যখন গল্প থেকে প্রশ্ন দিত তখন আমি দাদা কেই সেই প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিতাম। দাদা হয়তো ভুলে যেত কিন্তু মনে করিয়ে দিলে ঠিক লিখে দিত। প্রতিবার স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট আমি দাদাকে দেখাতাম সেই দেখে দাদা বলতো ভালো হয়েছে পরের বার আরো ভালো হবে ।স্কুলের ইংরেজি পরীক্ষা থাকলে আমি নিচে গিয়ে দাদার টিভি অফ করে বলতাম পড়াও দাদা মাঝপথে পথে টিভি টা নিভিয়ে দেওয়ায় একটু বিরক্ত হতো কিন্তু পড়াবো না বলে কোনদিন রাগ করেনি। আমি দাদার কাছে কোনদিনও মার খাইনি বকা একটু-আধটু খেয়েছি কিন্তু সেই বকা আমার কাছে কিছুই মনে হত না। দাদা একা থেকে বই পড়তে খুব ভালোবাসতো। মাঝে মাঝে কবিতাও বলতো। তার ওই কবিতা শুনে আমারও কিছু কিছু কবিতার লাইন মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। যেমন
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধনী ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয় তরণী। জানে না আপনা, জানে না ধরণী, সংসার কোলাহল।
দাদা এই কবিতাটাই বেশি বলতো। দাদা আর এই বিশ্বে নেই আর কোনদিন ফিরে ও আসবেনা। আর সারাটা জীবন দাদা সবার মনেই থেকে যাবে। এই বিশ্ব থেকে চলে গেলে ও সবার মন থেকে তো চলে যেতে পারবেনা দাদা । চারতলায় গেলে চারতলা টা ফাঁকা ফাঁকা লাগে যদিওবা শুধু চারতলা টা নয় সারা বাড়িটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু দাদার সারা বাড়িতে ছড়ানো জিনিস দেখে মনে হয় দাদা যেন ওই চার তলার বিছানাটাতে এখনো বসে আছে। এখনো সেখানে বসে কবিতা বলে চলেছে। এখনো আমাকে ইংরেজি পড়াচ্ছেন ।
কৃষ্ণবলদেব মিত্র, মানুষটার নামটা যতটা বড়ো, মানুষটাকে তত গম্ভীর বলা চলে না। সত্যি কথা বলতে আমি কোনদিন মানুষটার মুখে হাসি ছাড়া আর কিছু দেখিনি। আমার এই ছোড়দাদুকে আমার প্রথম দেখা পুজোর সময়। পুজোর সময় বাড়িতে প্রচুর আত্মীয় আসে। কিন্তু সপ্তমীর সকালে যার আসা একদম নিশ্চিত ছিল, তিনি হলেন ইনি। পুজোর চারটে দিন গল্প, হাসি, ঠাট্টা, সব কিছুর মধ্যে এনার অবস্থান। সেই যুগ কেমন ছিল, কেমন ভাবে মানুষ থাকতো, এই নিয়ে কৌতহল নিরাময় করতে পারতো আমার এই দাদুটা।
পাজামা পাঞ্জাবি পড়তে পছন্দ করত। এই ড্রেসের চক্করে দাদু বলে প্রায়শই মানুষ ভুল করতো। কিন্তু তাসত্বেও এই নিয়ে পরে নিজেই হাসাহাসি করতো। বাড়ি থেকে বারণ করা সত্বেও বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি বলে এবাড়িতে চলে আসা। এতোটাই ভালোবাসা ছিল সবার প্রতি। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো এই জন্য। 2012 সালের ঘটনা। তিন ভাই অনেকদিন পর একসাথে বসেছে। তিনজনের ভেতরে ছোটবেলার ঘটনা নিয়ে আড্ডা হচ্ছে। আর আমি একটা ছোট্ট টুলে বসে সেই আড্ডার সাক্ষী।
মানুষগুলোর সেই হাসি, সেই আনন্দ, সেই ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, সেই স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে, শেষবার যখন দেখা হলো বেলুড়ে গিয়ে। সেই হাসিটা, সেই মানুষটার কথা বলাটা। এই অভাবটা সারাজীবন থাকবে।
যেখানেই থেকো, ভালো থেকো ফর্সাদাদু। এর পরেও হয়তো বেলুড় যাবো। কিন্তু তোমার সেই উপস্থিতি আর তোমার সেই স্মৃতিগুলো খুব মিস করবো।
শাখা প্রশাখা
ফর্সাকাকু - আমার ছোটকাকা -অপর্ণা মিত্র (Aparna Mitra), ভাইঝি (Niece)
'এপ্রিল ফুল'! - কথাটা শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। মজার দিন - সবাইকে বোকা বানানোর দিন। কিন্তু, এবার ১লা এপ্রিল আমরা পুরো পরিবার যে এভাবে বোকা বনে যাবো স্বপ্নেও ভাবিনি। গত ১লা এপ্রিল, ২০২০ ফর্সাকাকু, আমার ছোটকাকা আমাদের ছেড়ে চলে গেল - সন্ধ্যা ৮-৪৫ মিনিটে। করোনার আবহে লকডাউনের জন্য গাড়ি না পাওয়ায় শেষ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। এ ক্ষোভ আমার এ জীবনে মিটবে না। ছোট কাকাকে ফর্সা কাকু কেন ডাকতাম সঠিকভাবে মনে নেই। তবে, রংটা ফর্সা সেজন্যই হয়তো। ফর্সা কাকুর ভালো নাম কৃষ্ণ বলদেব মিত্র। সংক্ষেপে কে.বি. মিত্র। ডাকনাম বাবু। নামের শেষে বলদেব এর উৎস জিজ্ঞাসা করায় বাপী বলেছিল - তাদের সবার নামের শেষেই বলদেব ছিল। সবাই বলদেব বিয়োগ করলেও ফর্সাকাকুর টা থেকে যায়। বাপীর তিন ভাই। ফর্সাকাকু ছোট। ছোটখাটো, ফর্সা, মঙ্গোলীয়ান ধাঁচের একজন মানুষ।সকলেরই প্রাথমিক শিক্ষা আঁটপুরে - আমাদের গ্রামের বাড়ীতে থেকে আঁটপুর স্কুলে । আমার দাদু (ঠাকুর্দা) দৈত্যকুলে "প্রহ্লাদ" ছিলেন।।জমিদারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও আঁটপুরের জমিদারিতে না থেকে কলকাতায় বাস করতেন।কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। পাশাপাশি সার্ভেয়ারের কাজ করতেন। দাদুর রোজগার খুব ভালো ছিল। কলকাতায় দাদুর ঠিকানা ছিল বালিগঞ্জ। কিন্তু ,নাথ ব্যাংক ফেল করায় দাদু কপর্দকশূন্য হয়ে আঁটপুর ফিরে যেতে বাধ্য হন। ফলে ফর্সা কাকু ছোটবেলা থেকেই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে বড় হয়েছে। ফর্সা কাকু রিপন কলেজ ( বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) কল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে এবং রেলের চাকরিতে যোগ দেয়। পোস্টিং হয় বিহারের দানাপুর । পরবর্তী কালে চারুচন্দ্র কলেজ থেকে কমার্স নিয়ে স্নাতক হয়।
বাপীদের খুব ছোট বয়সে মাতৃবিয়োগ হয়। ফর্সা কাকুর বয়স তখন দেড় বছর। দাদু কলকাতায় থাকার কারণে আমার ঠাকুমা কাকু আর ফর্সা কাকুকে নিয়ে তার বাবার কাছে বেলুনে থাকতেন।ঠাকুরমার মৃত্যুর পর দাদু কাকু আর ফর্সা কাকুকে নিয়ে আঁটপুরে চলে আসেন। ফর্সাকাকুকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন ওদের পিসি - মলিনা সুন্দরী দত্ত - যাকে ওরা পিনা বলে ডাকত। আমার ছোটবেলায় প্রায় প্রতিমাসেই ফর্সাকাকু আঁটপুরে আসতো - পিনার সাথে দেখা করতে- মাসের কোনো এক রবিবার। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। আত্মীয়-পরিজনদের যাতায়াতও ছিল কম। ফর্সা কাকু এলে বাড়িতে খুশির হাওয়া বইত - কত কথা, কত গল্প। আমার মামনির সাথে ফর্সাকাকুর খুব মধুর সম্পর্ক ছিল - হয়তো সমবয়সী হওয়ার কারণে। যদিও ফর্সা কাকুর বিয়ের কথা আমার পরিষ্কার মনে নেই, আঁটপুর থেকে বিয়ে হয়েছিল এবং বর-কনে মার্টিন ট্রেনে চেপে এসেছিল বলে শুনেছি। দিদা বলতো - ফর্সা কাকুর নাকি ভালোবাসার বিয়ে। আজ থেকে প্রায় 60 বছর আগে !!! ভাবা যায় !!! কত রোমান্টিক ছিল ফর্সাকাকু !!! কাকিমার নাম আরতি। ওদের পরিবার মানে রায়চৌধুরী পরিবারের ও বাস ছিল বালিগঞ্জে। আমাদের পরিবারের সাথে ওদের পরিবারের খুব সুসম্পর্ক ছিল।
কাকিমার প্রতি ফর্সাকাকুর আস্থা আর নির্ভরতা বুঝতে অসুবিধা হতো না। কত সময় কাকিমার বকুনি খেয়েও ফর্সা কাকুকে চুপচাপ থাকতে দেখেছি। বেলুড়ের বাড়িটাও তৈরি হয়েছিল কাকিমার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে। তরুণ বয়সে ফর্সাকাকু বাম রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিল। শুধু তাই নয় বেশ সক্রিয় ছিল। বাপি কে এই নিয়ে চিন্তা করতে দেখেছি। মামণির সাথে আলোচনা করতে দেখেছি - যদিও বাপিও সক্রিয়ভাবে বামপন্থী রাজনীতি করতো। বাপি খালি চিন্তা করত বা ভয় পেত - ফর্সাকাকুর চাকরি না চলে যায় বা জেল না হয়। পরবর্তীকালে যেকোনো কারণেই হোক, ফর্সা কাকুর মতাদর্শের পরিবর্তন হয়। এই নিয়ে আমার সাথে বা শান্তনুর সাথে অনেক তর্ক বিতর্ক ও হয়েছে। তবে শেষ দিকে, ফর্সা কাকুকে রাজনীতি নিয়ে আর কোন সক্রিয় আলোচনায় যোগ দিতে দেখিনি।
দানাপুর থেকে ফর্সাকাকুর রেলের লিলুয়া ওয়ার্কশপে পোস্টিং হয় এবং বেলুড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করে। পরবর্তীকালে, বেলুড়ে নিজের বাড়ি তৈরি করে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর আমি ফর্সা কাকুর সাথে কলকাতায় ন কাকুর বাড়ি গিয়েছিলাম - জয়েন্ট পরীক্ষা দেবার জন্য। এরপরও বহুবার বেলুড়ের বাড়িতে গিয়েছি এবং থেকেছি। সেই সময় ফর্সা কাকু অনেক টিউশন করত এবং শিক্ষক হিসেবে ভালোই সুনাম অর্জন করেছিল।আমাদের পরিবারের ধারা কিনা জানিনা ফর্সা কাকুর মধ্যেও একটা একগুঁয়ে বা জেদি ভাবছিল যাকে শুদ্ধ ভাষায় বলে মানসিক দৃঢ়তা। তাই, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়েও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে অসুবিধা হয়নি এবং জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ফর্সাকাকু খুব সাবলীল ছিল। বাপির সাথে মানসিক দূরত্ব থাকলেও ফর্সা কাকুর সাথে আমি খুব সাবলীল ছিলাম। বাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ফর্সা কাকুকে পাশে পেয়েছি। বিশেষতঃ, আমার বিয়ের সময় যখন সব সামাজিক নিয়ম ভেঙে বিয়ে করেছিলাম।
ফর্সা কাকুর গলার স্বর এর মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। সবসময়ই মনে হতো কথার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম হাসির আভাস মিশে আছে। বহুবার এমনকি তর্কবিতর্কের সময়ও গলার স্বরের বা অভিব্যক্তির পরিবর্তন হতে দেখিনি। ফর্সাকাকুর দুই ছেলে – ঝামেলা (কৃশাণু) ও পাপু (কৌস্তুভ), দুই পুত্রবধূ - বুবাই (ববিতা) ও তনিমা, দুই নাতি ফুচাই (কুন্দনীভ) আর ঋজু (ক্ষৌনিষ) আর এক নাতনী তিতির( কাজরী)। ঝামেলা, পাপু এবং ফুচাইয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ফর্সাকাকুর বিশাল প্রভাব ছিল।ঋজু আর তিতির সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ফর্সাকাকু একজন ছোটখাটো মিস্ত্রি ছিল। কাকিমা বলতো - বিশ্বকর্মা। যখনই গেছি খুটখাট, ঠুকঠাক লেগেই আছে - তা সে কাঠের কাজ, বিদ্যুৎ লাইনের কাজ বা জলের লাইনের কাজ - যাই হোক না কেন। বাড়িতে ছোটখাটো কাজের জন্য মিস্ত্রির প্রয়োজন হতো না।
আমার সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। কাকিমার সাথে আমার নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ ছিল। অনেক সময় ফর্সা কাকু ফোনটা ধরতো। একবার তো ফর্সাকাকুর মোবাইল থেকে আমার ফোনে হঠাৎ ফোন এলো। বলল আজই টকটাইম শেষ হয়ে যাবে তাই তোকে ফোন করছি। খুব খুশি হয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল, তবুও অসুস্থতাকে তার মনে কোন প্রভাব ফেলতে দেখেনি। সবসময়ই বলতো - আমি ঠিক আছি, তোর কাকিমা ঠিক নেই। বুঝতে পারতাম - কাকিমার অসুস্থতা তার এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ। আমার মামনির ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মুখাগ্নি বা শ্রাদ্ধ শান্তি কিছুই হয়নি। ফর্সাকাকু শুনে বলেছিল - বৌদি পথ দেখিয়ে গেছে। এই উক্তি তার প্রগতিশীল চিন্তাধারার পরিচয় দেয়। ফর্সাকাকুর সাথে আমার শেষ দেখা জানুয়ারি মাসে - সোফা থেকে পড়ে গিয়ে চোখে চোট লেগেছিল। আমার বিজ্ঞ ভাইরা আমাকে খবর দেয়নি। খবর পেয়ে আমি আর রিণু দেখতে গিয়েছিলাম। তখন অনেকটাই সেরে উঠেছে। এবারও, মূত্রে রক্তক্ষরণের কারণে ফর্সাকাকু হাসপাতালে ভর্তি আমি জানতেই পারি নি। যথারীতি, আমার বিজ্ঞ ভাইরা আমাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। প্রথম জানলাম রিণুর কাছে 'জনতা কারফিউ' র দিন ২২শে মার্চ। ঐদিন রিণুর ননদ অসুস্থ হয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২৪শে মার্চ আলপনা দি মারা গেল আর ফর্সা কাকুর অপারেশন হল। তখন 'লকডাউন' চালু হয়ে গেছে অতএব যেতে পারলাম না। দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠছিল - ১লা এপ্রিল বাড়ি ও ফিরল- কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। জীবিত অবস্থায় বা শেষকৃত্যের সময় ফর্সাকাকুর সাথে আমার না দেখা হওয়ার ক্ষোভটা সারা জীবন থাকবে ।
ফর্সাকাকু এভাবে হঠাৎ চলে যাবে কোনদিনও ভাবিনি। আমাদের পরিবারে ৮৫-৮৬ বছর বয়স কোন বয়সই নয়। কাকু গত ডিসেম্বরের ২০ তারিখে চলে গেল ৯৩ বছর বয়সে, বাপির এখন ৯৭ চলছে। ২০১৮ সালের ১৪ই এপ্রিল মামণি চলে গেল। আজ ঠিক দু বছর পূর্ণ হল। কাকু চলে যাবার পর তিন মাস ২৫ দিন আর আর ফর্সাকাকু চলে যাবার পর ১৪দিন। "একে একে নিভিছে দেউটি" । 'লকডাউনের' এই গৃহবন্দী দিনগুলো তে মাঝে মাঝে ভীষণ বিষণ্ণ লাগে - স্বজন হারানো বেদনার সাথে সাথে শেষকৃত্যে সামিল হতে না-পাওয়ার অসহায়তায়।
আমার ফর্সা কাকু - কবিতা মিত্র (Kabita Mitra) , ভাইঝি (Niece) পয়লা এপ্রিল 2020 , রাত এগারোটা। পাপু ফর্সা কাকুর ছোট ছেলে ,আমার ভাই। বেলুড় থেকে দুটো মোটর বাইক নিয়ে উত্তরপাড়ায় এল আমায় নিতে। ফর্সা কাকু মারা গেছে। রাতেই দাহ হবে বালি বার্নিং ঘাটে। বিলাসদা, আমার দেওর সঙ্গী হলো। বিশ্বজুড়ে Corona থাবা বসিয়েছে ,লকডাউন চলছে ,রাস্তাঘাট ফাঁকা,পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে আমরা বেলুড় পৌছালাম।
এই তো মাত্র কয়েক কয়েক ঘন্টা আগেই পাপুর সাথে ফোনে কথা হলো। হাসপাতাল থেকে ফর্সা কাকু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। চা খেয়ে কাকিমার সাথে গল্প করেছে। ঘরে ঢুকে কাকিমাকে বলা প্রথম কথা ছিল দেখো বেঁচে ফিরে এলাম। নিয়তি আছে কিনা জানিনা, বোধহয় হেসেছিল , কয়েক ঘণ্টা বাদেই তার মৃত্যু হল। জীবনে এপ্রিল ফুলের অনেক গল্প শুনেছি, কিন্তু ফর্সা কাকু আমাদের সবাইকে এপ্রিলফুল করে চলে যাবে ভাবি নি। গত কয়েক মাস ধরে আমাদের পরিবারে যেন মৃত্যু মিছিল চলেছে। ডিসেম্বরের শেষে কুড়ি 12/2019 আমার কাকু রঞ্জিত মিত্র আমাদের ছেড়ে চলে গেল তারপর একে একে বদ্রীনাথ কাকা, মুন্নার মামা, শ্যামল কাকা, কাকিমা চৈতালিদিরমা, আমার ননদ আলপনা দি চলে গেল। এই এপ্রিল মাসেই 14/4/2018 আমার মামনি আমাদের সমস্ত বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছিল। আজকাল গ্রীষ্মের বিকেল গুলো বড় মায়াময় লাগে, চারিদিক খা খা করছে, দূর থেকে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক, সন্ধ্যে যেন হতেই চায় না। বিশ্ব চরাচর জুড়ে অদ্ভুত বিষন্নতা। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় ফর্সা কাকু আমাকেও দিদিমণিকে আধুনিক পোশাক কিনে দিত, সেই পোশাক দেখে অনেকেই নাক সিটকাটো, অনেক পরে তাদের এবং তাদের মেয়েদের ওই ধরনের পোশাক পরতে দেখেছি। বোঝাই যায়,ফর্সা কাকু সময় এর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। রেলওয়ে রিক্রিয়েশন ক্লাবের ফর্সা কাকুকে নাটক করতে দেখেছি। আমার ভাসুর সুভাষ দের মুখে শুনেছি ফর্সা কাকু আঁটপুর স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ঝামেলার ছেলে ফুচার পড়াশুনো ফর্সা কাকুর কাছে, দিপু দাও ওনার কাছে পড়েছিল। শিক্ষক হিসেবে উনি সফল ছিলেন। আমাদের পরিবারের সবথেকে উজ্জ্বল ছেলে ফুচা। IIT Kharagpur থেকে পাশ করেও এখন Holland এর Eindhoven এ আছে। আমি নিশ্চিত , ফুচা ফর্সা কাকুর কাছে না পড়লে এতদূর যেতে পারত না। ফর্সা খুকু অবশ্য আক্ষেপ করে বলতো, কত গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করে দিলাম অথচ আমার দুটো ছেলে আমার কাছে পরল না। ভোর তিনটের সময় ঝামলারা দাহ শেষ করে বাড়ি ফিরল। কাকিমা কেঁদেই চলেছে ক্রমাগত। ঝামলা, ফুচা কে ভিডিও কল করলো। অস্ফুট স্বরে কাঁদতে কাঁদতে ফুচা, কিছু বলছিল,বোঝা যাচ্ছিল না, সব ছাড়িয়ে ফুচার হাহাকার বিরাট হলঘরে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল। এই প্রথম বিষাদগ্রস্ত কাকিমার মুখটা প্রসন্ন হয়ে উঠলো ।
আমার দেখা ফর্সাকাকু -অলোক মিত্র (Alok Mitra), ভাইপো (Nephew)
বসেছি স্মৃতি রোমন্থনে। আমার লেখনী বড়ই দুর্বল। সালটা ১৯৮২, সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরের দিকে বেড়িয়ে আসার একটা সুযোগ এল। আমার বাবার ছোট ভাই "বাবু" আমাদের "ফর্সাকাকু" কর্মসূত্রে স্বপরিবারে লিলুয়ায় থাকে। ফর্সাকাকু মাসে ১-২ বার গ্রামের বাড়িতে আসত এবং ১-২ দিন থাকত। সেই সময় আমার তার সাথে বাড়ির বাইরে যাবার সুযোগ পেতাম। আমার দুই খুড়তুতো ভাই বৎসরে ২-৩ বার গ্রামের বাড়ীতে আসতো এবং কয়েক দিন থাকতো। তখন আমরা মনের আনন্দে খেলা এবং গল্প করতাম। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে একদিন ফর্সাকাকু এসে আমায় লিলুয়া নিয়ে গেল। সেখানে প্রায় এক মাস মহানন্দে কাকা, কাকিমা ও ভাইদের সাথে কাটলো। আমার প্রথম বেড়াতে যাওয়া ফর্সাকাকুর সাথে দীঘা। সেবার ফর্সাকাকুর অফিস থেকে দীঘায় পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল। আমি ও খুড়তুতো ভাই ফর্সাকাকুর সাথে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম সমুদ্র দর্শনে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। 'ফর্সাকাকু' ও 'ঝামেলার' অনুপ্রেরণায় আমার গীটার শেখার শুরু লিলুয়াতে। পরবর্তীকালে কলেজ জীবনে আমি দুই বৎসর লিলুয়াতে কাকার কাছে থেকে পড়াশোনা করছি। কাকা, কাকিমার কাছে তাঁদের সন্তানের মতো স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। সেই সময় মাঝে মধ্যে যখন কাকিমা ১-২ দিনের জন্য তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে দাদা ও ভাইদের সাথে দেখা অথবা দুর্গাপুরে বোনের বাড়ি যেতেন তখন ফর্সাকাকুর উপরেই আমাদের দেখাশুনার দায়িত্ব থাকতো এবং ফর্সাকাকু ঐ সময় আমাদের কাকিমার অনুপস্থিতি বুঝতে দিত না। কাকিমার সাথে আমিও অবশ্য দু এক বার বালিগঞ্জ ও দুর্গাপুর বেড়িয়ে এসেছি। ফর্সাকাকুর কেন জানিনা আমার উপর খুব আস্থা ছিল। ফর্সাকাকু মনে করতো আমায় কোনো দায়িত্ব দিলে আমি তা সঠিক ভাবে পালন করতে পারবো। এ ব্যাপারে একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমার কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর একবার ফর্সাকাকুর অফিস থেকে কোনো এক স্থানে ভ্রমণের ব্যবস্থা হয়েছিল। ফর্সাকাকু ও কাকিমা বেড়াতে যাবে কিন্তু দুই ভাই চাকরি এবং স্কুলের কারণে যেতে পারবেনা। অতএব কাকা ও কাকিমা পড়ে গেলেন চিন্তায়। আমি তখন আঁটপুরের বাড়িতে রয়েছি এবং বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। খবর পেয়ে হাজির হলাম লিলুয়া। সব শোনার পর সময় তাঁদের আশ্বস্ত করলাম যে আমি এই কয়দিন লিলুয়া থাকবো এবং আমার দুই খুড়তুতো ভাই 'ঝামেলা' ও 'পাপুর' কোনো অসুবিধা হবে না। এ কথা শুনে ফর্সাকাকু বলেছিল "তুই পারবি তো?" আমি বলেছিলাম তোমরা নির্ভাবনায় বেড়িয়ে এস কোনো অসুবিধা হবে না। ফর্সাকাকু বলেছিল "তুই থাকলে অসুবিধা হবেনা আমি জানি।" ফর্সাকাকুর জগৎটা ছিল অন্যরকম। অবসর সময় ফর্সাকাকু বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্য চর্চায় ব্যস্ত থাকত, সাথে ছিল নাটক ও আবৃতি করার নেশা। প্রতি বৎসর অফিসের নাটকে অংশ নিত। এ ছাড়াও একসময় প্রচুর টিউশন করত। ফর্সাকাকু যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেল অর্থাৎ ১লা এপ্রিল ২০২০ সেদিন করোনা ভাইরাস সংক্রামণের কারণে গোটা দেশ জুড়ে লক ডাউন থাকায় মৃত্যু সংবাদ পেয়েও শেষ দেখা দেখতে যেতে পারলাম না ও শেষকৃত্যে থাকতে পারলাম না এ দুঃক্ষ আমার চিরকাল থাকবে।
আমার মশাই - সৌমেন্দু শেখর রায় চৌধুরী (Soumendu Sekhar Roy Chowdhury), শ্যালক্পুত্র (Nephew)
পিসেমশাই এর সাথে আমার পরিচয় জন্মের পরে অর্থাৎ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অত কম বয়সের স্মৃতি স্থায়ী হয় কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন আছে কিন্তু এই সময়ের কিছু ঘটনা খুব সামান্য হলেও আমার মনে আছে এখনো। আমার মনে আছে একবার বেশ কিছু সময় ধরে আমার জেঠু আর পিসেমশাই এর একটা কথোপকথনের কথা। বলা বাহুল্য পুরোটাই ইংরেজিতে যার অর্থ আমার কাছে বোধগম্য না হলেও শুনতে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। বলে রাখা দরকার আমার জেঠু মিসা বলে একটি পত্রিকা আমার জন্য আনা তো অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এবং মনে করে পড়াতো এবং বুঝিয়ে দিত। কিন্তু তার অল্প কিছুদিন পরে আমার জেঠু মারা যান তখন কিছুদিন আমার মশাই আমাকে ওই মিশা পত্রিকা পড়িয়েছিলেন। তার কিছুদিন পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং মিশা আসা বন্ধ হয়ে যায়। আমার মশাই বেশ গুরুগম্ভীর এবং বাজখাই গলার মানুষ ছিলেন তাই ছোটবেলায় আমি তাকে কোন বেশ ভয় পেতাম কোথাও একসাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা হলে কে কে যাচ্ছে প্রশ্ন করে মশাই যাচ্ছে জানতে পারলে আমি বলে থাকতাম "আবাল মতায় কেন"?
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মশাইকে ভয় পাওয়াটা আমার কমে যায় এবং তারপর থেকে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা মশার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম। বিভিন্ন বিষয়ে উনার অগাধ জ্ঞানআমাকে বিস্মিত করত। মাঝে মাঝে সত্যজিতের সিধু জ্যাথা সাথে মিল পেতাম এর পর একবার পিসেমশাই এর সাথে আমি পুরুলিয়া বেড়াতে যাই যদিও সেখানকার কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা মশাইকে নিয়ে আমার মনে পড়ে না। ইতিহাস ভূগোল অংক বিজ্ঞান সবকিছু নিয়েই আমার আর মশায়ের সঙ্গে কথা হতো।
ও হ্যাঁ আরেকটা কথা মাথায় এলো পিসেমশাইরা তিন ভাই যথাক্রমে অজিত মিত্র, রঞ্জিত মিত্র এবং কৃষ্ণ বলদেব মিত্র। আমি একবার জিজ্ঞাসা করি আগেকার দিনের মিলিয়ে নাম রাখার একটা প্রথা লক্ষ্য করা যেত সেখানে অজিত এবং রঞ্জিত নাম দুটির মধ্যে মিল থাকলেও কৃষ্ণদেব নামটাতো মিলল না। তখন মশাই বলেন উনার বাবা একসময় একজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ করতেন তিনি এক বারাকপুরে অর্থাৎ দেশের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন এবং তিন ভাইয়ের নামকরণ করে যান নামগুলি ছিল যথাক্রমে শ্রীধর বলদেও, দামোদর বলদেও, এবং কিষাণ বলদেও। কিন্তু মশাইয়ের দাদা এতদিন এই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছেন তাই তাদের নাম পাল্টানো সম্ভব হয়নি । কিন্তু আমার মশাই তখনো ছোট স্কুলে ভর্তি হননি তাই তার নামটা একটু বাঙালি বাঙালি করে রাখা হলো কৃষ্ণ বলদেব মিত্র।
পয়লা ডিসেম্বর 2019 আমার পিসেমশাই এর সাথে শেষ দেখা হয় বেলুড়ে। পিসিমণির বাড়ি গিয়েছিলাম গিয়ে চার তলায় উঠে যাই মশাইয়ের কাছে । ওখানে গিয়ে দেখি মশাই একটা ব্রাশ দিয়ে গলার বেলটা পরিস্কার করছিল। যতক্ষণ শারীরিক সক্ষমতা ছিল নিজের কাজ নিজে করাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন 'বস। বাবা কেমন আছে?'। আমি বললাম পায়ে ব্যথা তাই এখন খুব প্রয়োজন ছাড়া বেরোয় না। শুনে বললো ও তার মানে আমার মত ফিট নয়। আর বলল আমার এই চার তলার ঘরে যেকোনো মানুষের থাকার মত সবরকম ব্যবস্থা আছে । কারোর কোন অসুবিধা হবে না। বলল ওই দিকটা একবার দেখে আসো স্নানের ব্যবস্থাও আছে। দেখলাম বালতি মগ জলের ব্যবস্থা রয়েছে আরেকটি কমোড বসানো আছে কিন্তু উপর দিকটা ফাঁকা খোলা আকাশ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ও মশাই এখানে তো ওপর দিকটা ফাঁকা। বলল "হলেই বা। ভালো করে দেখো আশেপাশে কোন বাড়িতে কিন্তু চারতলা নেই । একমাত্র একটি বাড়ি আছে যেটা চার তলা, সেই বাড়ির ছাদে যদি কেউ ওঠে তবে সেখান থেকে দেখা যাওয়া সম্ভব।" মশাইয়ের চারতলার ঘরে যতটুকু আমার মনে পড়ছে ছিল একটা তক্তপোষ বা চৌকি তার উপর সতরঞ্চি পাতা একটা টেবিল-চেয়ার বেশকিছু পড়ার বই একটা টেলিভিশন ও দেয়ালে ঝোলানো একটি মানপত্র। বেশ কিছুক্ষণ আমরা গল্প করলাম তারপরে নিচে চলে গেলাম। সেই আমার সঙ্গে মশায়ের শেষ দেখা। এরপর পাপুদা এর কাছ থেকে শুনলাম মশাই কিছুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । একটা অপারেশনের জন্য । অপারেশন হয়ে গেছে কিন্তু এখন ভেন্টিলেশনে আছে । কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই কারণ পৃথিবী জুড়ে করার জন্য লকডাউন চলছে। সুতরাং উদ্বিগ্ন মন নিয়ে বাড়িতে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারপর আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি ঘটে এবং ভেন্টিলেশন থেকে জেনারেল বেডে দেয় এবং তারপর বাড়িতে আসেন কিন্তু যেদিন বাড়িতে আনা হয় তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। দাদা ভাইয়ের কাছে শুনলাম মশাই নাকি হাসপাতালে থাকাকালীন উপর দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ফাইনাল ফাইনাল কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। তখন হয়তো উনি বুঝতে পেরেছিলেন উনার সময় শেষ হয়ে এসেছে। এটা শোনার পর সুকুমার রায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল সুকুমার। তার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তার লেখা শেষ দুই লাইনে বলেছিলেন "ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর"।
চিলেকোঠার সেপাই - কুন্তলসিনহা (Kuntal Sinha), পুত্রবধূর ভাই (Brother of Daughter-in-law)
তখনও হয়ত পেশা নির্বাচনের বয়স হয়নি, মনের মধ্যে পড়ানোর বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। পরের দিকে শিক্ষকতাই পেশা হিসেবে নির্বাচন করি এবং স্কুলে চাকরি জুটে যায়। শিক্ষকতার পেশা আসলে সারা জীবনের মতো ছাত্র হওয়া। যার সম্পর্কে লিখতে বসা তাঁর সম্পর্কে না বলে কেন আমার এই গৌরচন্দ্রিকা ? আসলে যাকে নিয়ে লিখবো তিনি আমার প্রতিদিনের যাপনে খুব একটা এসেছেন তা নয়, কিন্তু তিনি আমায় নানাভাবে ঋদ্ধ করেছেন তার কাজের মাধ্যমে। তিনি নিজে একজন পেশাগত শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু শিক্ষকতার সব গুণই তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিলো। আমার শিক্ষক জীবনে অনেকধরনের শিক্ষক ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের সংস্পর্শে এসেছি। কিন্তু এই মানুষটির কাছ থেকে শিখেছি শিক্ষাকে কীভাবে জীবনের বাহন করে চলা যায়। ভাগ্নের পড়াশোনার সূত্রে জেনেছি ইংরাজি কিভাবে শব্দার্থ বুঝে in between the lines পড়া যায়- আলাদা খাতায় wordnotes; কারিগর কেবিদাদা। অঙ্কে পুরনো দিনের বইগুলো মন দিয়ে শেষ করা আর সর্বোপরি বিষয়গুলো ভালোবেসে পড়া। পড়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রমাণ পেয়েছি পরতে পরতে। অনায়াসে বলে যেতে শুনেছি রবীন্দ্রনাথের কবিতা- হসপিটালের বেডে বসে।
চিলেকোঠার ঘর ছিল তাঁর explorationএর জায়গা, একটা ভিন্ন জগত। যখনই গেছি কিছু না কিছু নতুন দেখেছি, তিনিই দেখিয়েছেন। কখনো চারতলার ঘর নিজে wiring করছেন তো কখনো ঘরের ছাউনি কী রকম হবে তা নিজেই করে দেখাচ্ছেন। খবরের কাগজ গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়া তার অভ্যাস ছিল। এরকম নিরহঙ্কার মানুষ, অনাড়ম্বর জীবনযাপন, এ যুগে খুব বিরল প্রাপ্তি। এ রকম মানুষের কাছে বারবার ফিরে যেতে মন চায়। আজকের এই বিজ্ঞাপন সর্বস্ব সমাজে মনে হয় এই শান্ত, সাহসী মানুষটির পায়ের কাছে বসি- শিখি। কিন্তু জীবিকা ভীষণ কঠিন ঠাঁই- সবসময় আমরা যা ভাবি তা তো হয়ে ওঠে না। শেষ দিনেও দেখা করতে পারলাম না, জীবনভর আফসোস থেকে গেলো। আপনার থেকে শেখা পথে যেন চলতে পারি... আমাদেরও একটা চিলেকোঠার ঘর আছে- আপনার মতোই যেন হতে পারি সেই চিলেকোঠার সেপাই।
কাছের মানুষ, দূরের মানুষ - শর্মিষ্ঠা সিনহা (Sharmistha Sinha) যাঁর স্মৃতিচারণ করতে এই লেখাটি, তিনি সম্পর্কে আমার একমাত্র ননদ, আমাদের দিদির শ্বশুরমশাই। তাঁর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ খুবই কম ছিল, তাঁর সম্পর্কে শুনেছি অনেক বেশি। আর এই দেখাশোনার মধ্য দিয়ে তিনি আমার, আমাদের আত্মজন হয়ে উঠেছেন। তাঁর গভীর প্রভাব আমাদের জীবনে পড়েছিল, চিরকাল সেই প্রভাব অম্লান থাকবে।
পদার্থবিজ্ঞান বলে ,আলো অদৃশ্য ,যার উপর আলো পড়ে সে দৃশ্যমান হয়। আমিও মেসোমশাই কে প্রথমে দেখিনি ,তাঁর পরম আদরের নাতি আমাদের ভাগ্নে কিচিং এর মধ্য দিয়ে তাকে জেনেছি। আজকের ডক্টর কুন্দনিভ মিত্র ,বেলুড়ের মিত্রবাড়িতে যে ফুচা, শিবপুরে মামার বাড়িতে সে ই তার দাদুর সন্টুবাবু, দিদার বানু দাদা, আর মামার কাছে কিচিং। আমরা কবির সেই আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছি ,”একজনেতে রাখবে নাম কখন অন্নপ্রাশনে/ বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে, ভারী বিষম শাসন-এ”। মেসোমশাই এর কথা বলতে গিয়ে চলে এলাম কিচিং-এর কথায়। আসলে দুজন তো আলাদা নন, দুজনে ছিলেন অত্যাগসহন বন্ধু ,সহচর । শুধু দাদু নাতির সম্পর্কের উপরে ছিল সেই অসমবয়সী সখ্য ।
ছোট্ট কিচিং যখন শিবপুরে আসত তার সঙ্গে থাকত দু-একটি কিশোর পাঠ্য ইংরেজি ক্লাসিক , আরেকটি খাতা যাতে রয়েছে চমৎকার হস্তাক্ষরে রচিত একটি শব্দার্থ সংকলন। তার কে বি দাদার নিজের হাতে গ্রথিত । কিচিং এর কথাবার্তায় ,তার কাজকর্মে দাদুর ছায়া। আমরা মুগ্ধ বিষয়ে দেখেছি সেই আশ্চর্য বালকের বড় হয়ে ওঠা ,তার দাদুর অমোঘ প্রভাব। অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর কিচিং মামার বাড়িতে এলো। নবম শ্রেণীর অঙ্কের পাঠক্রম তখন তার সমাপ্তপ্রায়। কারণ বিশেষ প্রয়োজনে দাদু যাবেন ত্রিপুরা ,নাতিকে একা ছেড়ে যাবেন কী করে ? তাই দিয়ে গেছেন সিলেবাস শেষ করার স্বস্তি, একক ভাবে পড়তে পারার, লড়তে পারার স্বাবলম্বন ,আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
মেসোমশাইয়ের সঙ্গে কখনো-সখনো কথা হয়েছে ,অনাড়ম্বর সহজ সেসব কথা। নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল না তাঁর । আমরা দেখেছি তার যন্ত্রপাতির ঘর, নিখুঁত দম দেওয়া দাদামশাই ঘড়ি। একবার আমরা বিজয়ার প্রণাম করতে গেছি সন্ধ্যাবেলায় , তিনি তখন তিনতলার নির্জন ঘরে মধুসূদন রচনাবলী পড়ছেন। সেসময় আমি ৫০ কিলোমিটার যাতায়াত করে চাকরি করি ,ছেলে একেবারেই ছোট্ট ,বইপড়া কাকে বলে ভুলতে বসেছি। নিবিষ্টমনা প্রৌঢ় পাঠকটিকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা আপনি নত হয়ে গেল। আমার মন আবার ফিরতে চাইলো বইয়ের কাছে। তিনি নিজে কেবল পজিটিভ মানুষ ছিলেন না, অন্যের মধ্যে ইতিবাচকতা জাগিয়ে তুলতে পারতেন। স্বল্প পরিচয়েও দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যেতেন অপরের মনে। তিনি পড়ুয়া ছিলেন , তিনি সংসারী মানুষ ছিলেন, তিনি কর্মী ছিলেন ,তিনি অধ্যবসায়ী ছিলেন। দিনের চব্বিশটা ঘন্টা নেহাত কম নয় ,কীভাবে তার সদ্ব্যবহার করতে হয় তাঁকে দেখে শেখা যেতো।
তাঁর কাছের মানুষরা তাঁর অভাব প্রতিনিয়ত বোধ করবেন । তিনি তাঁর উপর তলার ঘরটিতে একাকী কাটাতেন অনেকটা সময় কিন্তু ভালোবাসার শিকড়বাকড়গুলি ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন নীচের দিকে । প্রিয়জনদের আঁকড়ে ধরে ,ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন। আর আমাদের মতন দূরের মানুষের কাছে তিনি আলোকোজ্জ্বল কোনো বাতিঘরের মতো ,যার আলো অকূল সমুদ্রে পথ দেখাবে, অনুপ্রেরণা দেবে, অলক্ষ্যে সাহস যোগাবে । অন্তিম প্রণাম, মেসোমশাই।
মেসোমশাই - শচীকান্ত রেজা (Sachi-Kanta Reja), Family Friend 1988 এর শেষের দিক। কৌস্তুভ এর সঙ্গে পরিচয় সায়েন্স ক্লাবের মাধ্যমে। গোপীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের নতুন বাড়িতে যাতায়াত শুরু। ক্রমশ দাদা, মেশোমশাই, মাসিমার সঙ্গে পরিচয়। মুনি, অনল, তমাল, দেবাশীষ, সুব্রত, আমরা প্রায় 14-15 জন এর দল। নিয়মিতভাবে যাতায়াত করতাম। সন্ধ্যার আড্ডায় শৈল কাকু, ঝিন্টুদা, আপুদা, আশীষ দের সাথে যোগ দিতাম। মাঝে মাঝে গ্যাপ পরলে মাসিমা, বৌদি, এমনকি ছোট্ট ফুচার কাছেও জবাবদিহি করতে হতো। যা পরে তনিমা ও ঋজু মামণির কাছেও জবাবদিহি করতে হয়েছে। সেই আড্ডায় ছোট্ট ফুচার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকতো। এখান থেকেই ফুচার মনে group মেন্টালিটি জন্ম হয়। উদার চিন্তা ভাবনা এবং সুন্দর পারিবারিক বন্ধনের টানে আমিও কখন এই পরিবারের সদস্য হয়ে গেছি। এটা আমরা জীবনের একটা বড় পাওনা। মেসোমশাই এর সাথে বিভিন্ন আলোচনায়, তার চিন্তা ভাবনা প্রকাশের মাধ্যমে, ও বিশেষ সমৃদ্ধি বেড়ে ওঠার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি চিন্তাভাবনা পারিবারিক বন্ধন এর উৎস। দাদা কৌস্তুভের মানসিক গঠনের উৎস। অন্যায়ের সাথে কোন রকম আপস না করা প্রতিবাদী চরিত্রকে যেমন দেখেছি, আবার স্নেহশীল নীতিনিষ্ঠ পিতা ঠাকুরদাকে প্রত্যক্ষ করেছি। পরিবারের প্রত্যেকের উপর আস্থা রাখতে পারেন। শেষের দিকে সামান্য মানসিক দুর্বলতা দেখা দেওয়া ছাড়া মেসোমশাই কে বরাবর আত্মবিশ্বাসী লড়াকু মানুষ হিসাবে দেখে এসেছি। সেই ছবিটা মনে গেঁথে আছে, থাকবে । চিন্তা-চেতনায় কর্মে আমাদের মাঝে মেসোমশাই সর্বদায় থাকবে।
বন্ধুত্বের বয়স হয় না -সোমনাথ রায় (Somnath Roy), Family Friend
কোনো কিছু নিয়ে লেখা আমার খুব একটা আসে না । পারি ও না । অভ্যাস ও নেই । কিন্তু আজ বাধ্য হয়ে লিখতে বসলাম এমন একজন মানুষকে নিয়ে যার সম্বন্ধে দু চার কথা না লিখলেই নয় । আজ থেকে ২০ , ২১ বছর আগে চলে যাচ্ছি । আমরা কয়েকজন বন্ধুর পরিবার মিলে কেরালা বেড়াতে গিয়েছিলাম । সেই বেড়ানোর দু একটি ঘটনার কথা বলি । একদিন আমরা বাসে করে চলেছি । ঘন্টা ৫ , ৬ এর journey । বাস চলেছে । একজায়গায় বাস দাঁড়ালো কিছু সময়ের জন্য । আমরা দুই বন্ধু বাস থেকে নেমে ঘুরছি । একজায়গায় দেখলাম কিছু মানুষ একটা দোকানের সামনে ভিড় করে আছে । গিয়ে দেখি খাবারের দোকান । গোল গোল বড়ার মতো কি বানাচ্ছে, সবাই খুব খাচ্ছে । জিগ্যেস করতে বললো কলার বড়া । আমার লোভ হলো বললাম দাও । আমরা দুজনে খাচ্ছি । হঠাৎ পিছন থেকে একটা গলার আওয়াজ এ্যাই তোমরা ওটা কি খাচ্ছো ? ঘুরে দেখি বন্ধুর বাবা । বললেন আমাকে দাও, আমিও খাব । তাকে দুটো দিলাম । আনন্দ সহকারে খেলেন । বললেন বাঃ ভালো খেতে তো । যাইহোক আবার বাস চললো । একজায়গায় আবার দাঁড়াতে আমি নেমে পড়লাম । এবার একটু ধুমপান করার ইচ্ছা হলো । লুকিয়ে খেতে হবে বন্ধুর বাবা মা রয়েছেন সাথে । একটু দুরে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আড়ালে ধুমপান করছি । হঠাৎ সেই গলার আওয়াজ । আমাকে একটা দাও তো খাব । এবার লুকাবো না পালাবো । বললেন দাও দাও একটা খাই । কি আর করি দিলাম । উনি খেলেন । বললেন কাউকে বলো না যেন । যাক, বাসে এসে বসেছি । বাস চলছে । খুব লজ্জা লাগছে । কিছুক্ষণ পরে বন্ধুকে বললাম ঘটনাটা। ও তো শুনে আমাকে এই মারে তো সেই মারে । তুই আমার বাবাকে সিগারেট খাইয়েছিস । যাই হোক আমরা খুব মজা করে ঘুরলাম । এইরকম আমরা একসাথে আরো বেড়াতে গেছি, আরো অনেক ঘটনা ঘটেছিল । তারপর থেকে ধীরে ধীরে আমি ঐ মানুষটার খুব কাছে এসেছি । আমাকে খুব ভালোবাসতেন । পরবর্তী কালে দেখেছি ওনার মনের জোড় অসম্ভব । তাই দিয়ে উনি সব কিছু জয় করে ফেলতেন । আর ছিলেন খুব খাদ্যরসিক মানুষ । খাওয়াতে কোনো বাছবিচার ছিলো না । উনি বলতেন , শোনো মানুষের জীবনে যেদিন সবকিছু খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন আর বেঁচে থাকার কোনো মূল্য নেই । আমি ওনার সংস্পর্শে এসে অনেক কিছু শিখেছি জেনেছি । আর ওনার ঐ মনের জোড় টাকে আমি নিজের মধ্যে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি । আমি এতক্ষন যে মানুষটির কথা বললাম উনি আমার বন্ধু কৃশানুর বাবা , ফুচার কে.বি. দাদা , আমার মেসোমশাই কৃষ্ণ বলদেব মিত্র । যিনি গত ১লা এপ্রিল আমাদের সবাইকে এপ্রিল ফুল করে ইহলোক থেকে পরলোকে গমন করেছেন । আমি ওনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি ।
মানিকের কাকু - মানিক হালদার (Manik Haldar), Family Friend
কৃষ্ণ বলদেব মিত্র, তুমি আমাকে না বলে কেনো চলে গেলে? যাবার তো কথা ছিল না, কিন্তু কেনো গেলে? না কি তোমার সেই অনেকদিনের মানিক কে দেখতে না পেয়ে একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে চলে গেলে। আমি যানি এ আমার এক ব্যর্থতা। তোমাকে অনেকদিন দেখতে যেতে পারি নি, একটা খবরও নিতে পারি নি। কিন্তু, যখনি তোমার কথা মনে পড়তো ভাবতাম আট বছর বয়স থেকে শাসন অনুশাসন সুক্ষ্, স্নেহ ভালবাসার এক আঙ্গিকে আমাকে স্নিগ্ধ করে তুলেছ আমার বাল্যকাল থেকে যৌবনের আঙ্গিনায়। পরবর্তীকালে তোমার কাছ থেকে অনেক টা দূরে চলে গেলাম কিন্তু জানো আমরা (আমাদের পরিবার) সবাই তোমাদের কথা বারবার বলতাম, এ যেনো আত্মীয়র থেকেও বড়ো। কালের নীয়মে আমি পিতৃহারা হলাম কিন্তু মনে মনে একটা প্রত্যয় ছিল আমার কাকু আছে, যাকে আমি পিতৃসম ভাবী। তোমার বহুমুখী প্রতিভা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করতো। সবকিছুতেই কি সাবলীল ছিলে তুমি। তোমার ধৈর্য, তোমার অধ্যবসায়, তোমার আন্তরিকতা এবং সর্বোপরি তোমার ঐকান্তিকতা, আমায় মুগ্ধ করতো। একটু দুষ্টুমির জন্য তোমার কাছে বকা খেয়েছি। পরে অনুধাবন করেছিলাম আমার ভালোর জন্য। তোমার সবদিকে নজর ছিল। আজও ভাবী তুমি যদি আমাদের কাছাকাছি থাকতে তাহলে কি ভালোটাই না হতো, তুমি আর কাকীমা আমাদের যে স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছিলে তার তুলনা আর পারছি না। কলম এগোচ্ছে না চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তুমি যেও না যেতে পারো না,তাহলে তোমার মানিক কে শাসন করবে কে? ......